রাজনীতি

আওয়ামী লীগে নতুনের ভিড়, পুরনোতে ভরসা বিএনপির

পার্থ সারথী দাস, ঠাকুরগাঁও

আওয়ামী লীগে নতুনের ভিড়, পুরনোতে ভরসা বিএনপির

 

ঠাকুরগাঁও-১ (সদর) আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নতুন যাঁরা মনোনয়নের প্রত্যাশায় মাঠে কাজ করছেন, তাঁদের সংখ্যা অন্তত ছয়। আছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনও। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই এ আসনে নির্বাচন করবেন—এমন আলোচনা রয়েছে। তবে দলটির স্থানীয় একজন নেতাও মনোনয়নের প্রত্যাশায় মাঠে কাজ করছেন।

জাতীয় সংসদের ৩ নম্বর আসন ঠাকুরগাঁওয়ের এ নির্বাচনী এলাকাটি আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে পরিচিত। তবে ২০০১ সালে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভেদ থাকার কারণে মনোনয়নের জন্য একাধিক নেতা মাঠে নেমেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়। এতে প্রার্থী বাছাই নিয়ে বিপাকে পড়তে পারে ক্ষমতাসীন দলটি। অন্যদিকে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীরা দাবি করছে, তারা আগে থেকেই দল গুছিয়ে রেখেছে।

আওয়ামী লীগ : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ঠাকুরগাঁও-১ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন ছাড়াও দলের একাধিক নেতা মনোনয়নের প্রত্যাশায় গণসংযোগে মাঠে নেমেছেন।

তাঁরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সাদেক কুরাইশী, একই কমিটির সহসভাপতি মকবুল হোসেন বাবু, আইনবিষয়ক সম্পাদক ইন্দ্রনাথ রায়, দলের সদর উপজেলা শাখার সভাপতি অরুণাংশু দত্ত টিটো, দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক রাজিউর রেজা খোকন চৌধুরী ও যুব মহিলা লীগ সভাপতি তাহমিনা আক্তার মোল্লা। তাঁরা মাঠপর্যায়ে গিয়ে নিজেদের যোগ্য প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরছেন।

আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করে, বর্তমান সংসদ সদস্য ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। নতুন কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগের বিজয়ে বেগ পেতে হবে।

বর্তমান সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি দীর্ঘদিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া তৃতীয়বারের মতো এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিগত সময়ে পানিসম্পদমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত তিনি জনগণ ও দেশের উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছেন। বিশেষ করে ঠাকুরগাঁওয়ে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা, মন্দির-মসজিদ স্থাপনসহ অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, যা দৃশ্যমান। তিনি দাবি করেন, অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এলাকায় এত উন্নয়নকাজ হয়নি। এসব কাজের সুফল এ জেলার মানুষ ভোগ করছে। সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রীর ‘ভিশন-২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

রমেশ চন্দ্র সেন বলেন, ‘আগামীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি, চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঠাকুরগাঁওকে একটি মডেল জেলা হিসেবে গড়ে তোলাসহ বর্তমান সরকারের অসমাপ্ত সব কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এখানে আওয়ামী লীগের কিছু রিজার্ভ ভোট রয়েছে, যা আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ব্যক্তিগত জীবনে আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, সারা জীবন মানুষের সেবা করেছি, আগামীতেও সেবা করে যেতে চাই। ’

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সাদেক কুরাইশী জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে দলকে সুসংগঠিত করে রেখেছেন। বর্তমানে দলে কোনো বিভেদ নেই। দলকে পুনর্বিন্যাস, দলীয় বিভিন্ন সভাসহ বিগত দিনের ছোটখাটো কিছু ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইব। দল যোগ্য মনে করলে অবশ্যই মনোনয়ন দেবে। তবে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা যাঁকেই মনোনয়ন দেবেন, তাঁর পক্ষেই আমরা কাজ করব। ’

এ আসনে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বর্তমান সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অরুণাংশু দত্ত টিটো বলেন, তিনি ১৯৯৬ সালে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি দাবি করেন, ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি দলের সমর্থনে প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু নিজ দলের কয়েকজন নেতা গোপনে তাঁর বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্র করায় তিনি হেরে যান। বর্তমানে জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে টিটো বলেন, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে রাজপথে থেকে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। মিথ্যা অভিযোগে করা মামলায় তাঁকে সাত মাস ১১ দিন জেল খাটতে হয়েছিল। তিনি বলেন, এ এলাকার যুবকশ্রেণির ৮ শতাংশ সমর্থন তাঁর পক্ষে রয়েছে। মনোনয়নের ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ে তৃণমূলে নির্বাচনের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই হলে তিনি বিপুল সমর্থন পাবেন। কারণ জনপ্রতিনিধি না হয়েও তিনি নিজ দল ও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। মনোনয়ন পেলে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ইন্দ্রনাথ রায় বলেন, ‘এ আসনের মানুষ পরিবর্তন চায়। তাই একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি এবার এই আসনে দলীয় মনোনয়ন চাইব। ’ তিনি জানান, স্বাধীনতার আগে থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সদস্যপদ লাভ করেন।

১৯৯১ সালে এ আসনের তখনকার সংসদ সদস্য খাদেমুল ইসলামের নির্বাচনী এজেন্ট থাকার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে ইন্দ্রনাথ জানান, এখন যাঁরা মনোনয়নপ্রত্যাশী, তাঁরা কেউই ওই সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। বর্তমানে দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো রকম দুর্নীতির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না। তাঁর দাবি, তিনি মনোনয়ন পেলে বিএনপির ভোটও তাঁর পক্ষে আসবে। তিনি নির্বাচিত হলে এলাকায় আরো ব্যাপক উন্নয়ন করবেন। পাশাপাশি দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলবেন।

বিএনপি : এর আগে বিএনপির প্রার্থী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছিলেন শুধু জেলা বিএনপির সভাপতি। কিন্তু এবার তিনি দলটির মহাসচিব। আগামী নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-১ ও ঠাকুরগাঁও-২ আসনে তাঁর প্রার্থী হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও ঠাকুরগাঁও সদর আসন ছাড়া অন্য আসনগুলোতে বিএনপির সে রকম জনপ্রিয়তা নেই।

নেতাকর্মীদের দাবি অনুযায়ী, ঠাকুরগাঁওয়ের তিনটি সংসদীয় আসনের মধ্যে সদর আসনে বিএনপি আগের তুলনায় অনেক বেশি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী। এর প্রমাণ মেলে পৌরসভা ও সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে। দুটি নির্বাচনেই বিএনপি প্রার্থী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছে। মূলত আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দলের কারণে এমনটা হলেও নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম একাধিকবার এলাকায় আসেন। তাঁর এ আগমনই বিএনপি প্রার্থীর জয়ে ভূমিকা রেখেছে।

জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমূর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপি একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল। এখানে সব কিছুই নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলে। দলের বিভিন্ন পদের নেতাকর্মীরা জ্যেষ্ঠ নেতাদের কথার বাইরে যায় না। নেতাকর্মীরা একে-অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি বলেন, ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ঠাকুরগাঁওয়ের কৃতী সন্তান। তিনি একসময় জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এ জেলার মানুষ তাঁকে অনেক সম্মান করে ও ভালোবাসে। তাই এ আসনে আগামী জাতীয় নির্বাচনে তিনিই বিএনপির একমাত্র যোগ্য প্রার্থী। আগামী নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় তবে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবে। ’

তবে এ আসনে বিএনপির আরেকজন নেতা মনোনয়ন পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করে চলছেন। তিনি হলেন সাবেক সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও বর্তমানে জেলা বিএনপির সহসভাপতি সুলতানুল ফেরদৌস নম্র চৌধুরী।

নম্র চৌধুরী বলেন, পারিবারিকভাবেই তিনি খুব ছোটবেলা থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর বাবা প্রয়াত ইদু চৌধুরী ১৯৭২ ও ১৯৭৮ সালে এ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তাঁর বাবা এ জেলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করেছেন। ওই সময় জেলার কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। আর সেই কারণে এ জেলার মানুষ তাঁর বাবাকে এখন পর্যন্ত সম্মান করে এবং মনে রেখেছে।

বাবার হাত ধরেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন জানিয়ে নম্র চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে তিনি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে যোগদান করেন এবং পরে সহসভাপতির পদ লাভ করেন। বর্তমানে রাজনীতিতে যে ঠেলাঠেলি চলছে, তা খুবই হতাশার। বড় বড় নেতা নিজের অবস্থান তৈরি করতে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কখনোই বাস্তবায়ন করে না। নিজেদের স্বার্থে অন্যকে শুধুই ব্যবহার করে। এ জন্য তিনি নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চান। তাই বেশ আগে থেকেই নিজের সমর্থকদের নিয়ে অনেকটা গোপনে মাঠে নেমেছেন তিনি। কাজ করছেন সাধারণ মানুষের জন্য।

দলের মনোনয়ন পাবেন কি না, না পেলে কোন দলের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন—জানতে চাইলে নম্র চৌধুরী বলেন, সময় হলে তিনি সবাইকে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন।

অন্যদিকে এ আসনটিতে এখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থীকে মাঠে দেখা যায়নি। জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের সমর্থন নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তিনি জানান, গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেন। এবার যদি জোটগত নির্বাচন হয়, তবে তিনি তাঁর দল থেকে ১৪ দলীয় জোটের মনোনয়ন চাইবেন। তবে জোট বা দল যদি অন্য কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়, তবে তিনি তাঁর পক্ষেই নির্বাচন করবেন।

Comment here