এক্সক্লুসিভজাতীয়সারাদেশ

“বন্ধুত্যের মর্যাদা”

“বন্ধুত্যের মর্যাদা”

মোঃ আদিল মাহমুদ

আখতার চৌধুরী ও হাজী কাওসার দু’জনেই ছোট কালের বন্ধু, পাশা পাশি দু’জনেরই বাড়ি। আখতার চৌধুরীর বয়স ষাট ও হাজী কাওসারের বয়স বাষট্টি। দু’জনেই ব্যবসায়ী, সচ্ছল তাদের সংসার। আখতার চৌধুরীর বড় ছেলে নিরব ইটালীতে পড়াশুনা করে, আর ছোট ছেলে সবুজ এইচ,এস,সি পাস করেছে। অপরদিকে, হাজী কাওসার সাহেবের এক মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে সুরভা বাংলায় অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী, ছোট ছেলে মিঠু নবম শ্রেনীতে পড়ে।

দু’বন্ধুর এতো গভীর সর্ম্পক যে, সবাই তাদেরকে দু’ভাই বলেই ডাকতো। অতএব, দু’বন্ধুর অনেক ইচ্ছে তাদের সর্ম্পকটা আরো মজবুত করে গড়ে তোলার। তাই দু’বন্ধুই যুক্তি পরামর্শ করতে থাকলো, কি করে বন্ধন চির অটুট রাখা যায়। একদিন সন্ধ্যার পর আখতার চৌধুরী, হাজী কাওসার সাহেবকে তার বাসায় দাওয়াত করলো, যদিও প্রতিদিনই দু’বন্ধুর দেখা হয় এবং বাড়িতে যাতায়াত থাকে। তারপরেও দাওয়াত বলে কথা, আজকালতো দাওয়াত না দিলে জামাইও শ্বশুর বাড়ি যায় না!

সন্ধ্যার পর হাজী কাওসার সাহেব কিছু মিষ্টি নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে এসে হাজির। দু’বন্ধু দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলো, তারপর এক সাথে বসে মজা করে চা নাস্তা খেলো, হাসা হাসিতো আর ধরে না! এমন সময় আখতার সাহেবের স্ত্রী রাশিদা বেগম এসে দু’বন্ধুর আড্ডায় যোগ দিলো। অনেক মজাই হচ্ছিলো তাদের আড্ডায়। কথার ছলে আখতার চৌধুরী বলে উঠলো, বন্ধু কতোদিন বাঁচি তারতো কোন ঠিক নেই, তাই আমার খুব ইচ্ছে আমাদের বন্ধুত্বটা সারা জীবন অটুট থাকুক। হাজী কাওসার কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই রাশিদা বেগম বলে ফেললো, ভাই আপনার মাথায়তো আর চিন্তা নাই! আপনার মেয়ে সুরভা যে বড় হচ্ছে তা কি কখনো ভাবছেন, বিয়ে দিতে হবে না? এবার হাজী কাওসার কিছুটা আঁচ করতে পেরে বললো, হ্যাঁ ভাবী মেয়ে বড় হচ্ছে বিয়েতো দিতেই হবে। তবে ভাল পাত্র পাই কই বলুনতো? বন্ধুর কথা শুনে আখতার সাহেব হেসেই ফেললো। আরে পাগল পাত্রতো তোর আপন জন, ঘরের ছেলে। কি ব্যাপার বুঝলি না, আরে আমি আমার ছেলে নিরবের কথা বলছি। কথা শুনে কাওসার হাঁ হাঁ করে হেসে উঠে বললো, আরে এটাতো আমার মাথায়ই আসেনি। এ বলে দু’বন্ধু আবার কোলাকুলি করলো, ফলে আবার চা, চায়ের পর্ব শেষে এবার শুরু হলো কি ভাবে এটা সম্ভব! ছেলেতো ইটালীতে থাকে, কবে আসবে তারও কোন ঠিক নেই। তাহলে হবে কি? আখতার সাহেব বলতে লাগলো, ইটালীতে আছেতো কি হয়েছে! ওদের বয়স আর কতো হয়েছে, দু’তিন বছরের মধ্যেতো আসবেই, আপাতত: ফোনে বিয়ে হয়ে থাকবে। ফলে, দু’বন্ধু এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, ফোনের মাধ্যমেই কবুলটা সেরে নেবে, বাকি কাজ নিরব দেশে আসলে পরে করা যাবে।

আগামী শুক্রবার সন্ধ্যার পর বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করা হলো। নিরবকে ফোনে জানানো হলো আর সুরভাকে আজই জানিয়ে দিলো। এখানে ছেলে ও মেয়ের মতামতের কোন মূল্যই দেয়া হলো না। অন্যদিকে, নিরব ও সুরভা দু’জনেই ওদের বাবাকে চিনে। কারণ, বাবা যা বলে এতোদিন তাই হয়ে এসেছে। তাই, ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে বড় কোন বাঁধা আসলো না। তবে, নিরব ও সুরভা যে অন্য কাউকে ভালবাসতে পারে তা কারো বাবা/মা-ই ভাবলো না। ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে, তাদের যে নিজস্ব কোন মতামত থাকতে পারে তা বাবারা গুরুত্বই দিলো না। ফলে, যখন ফোনে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসলো, তখন উপায় না দেখে সুরভা তার মাকে বললো, মা আমি মফিজ নামে একটি ছেলেকে ভালবাসি, ভাল ছেলে ব্যাংকে চাকুরী করে। এ কথা শুনেতো মা’র মাথায় হাত, তাড়াতাড়ি গিয়ে সুরভার বাবার কানে কথাটা দিলো। কথাটা শুনেতো বাবা হাজী কাওসার রেগে আগুন। সুরভাকে ডেকে বললো, কাল পরশু বিয়ে তাও আমার প্রাণের বন্ধুর ছেলের সাথে! আমার জীবন গেলেও আমার কাথার বরখেলাপ হতে দিবো না! বাবার কথা শুনে সুরভা কাঁদতে লাগলো কারণ, সে যে মনে প্রাণে মফিজকে ভালবাসে। তাছাঁড়া দু’জন দু’জনকে পুরোপুরি কথাও দিয়েছে। সুতরাং, সুরভাও বাবার কথায় রাজি হতে পারলো না।

অন্যদিকে নিরবের অবস্থাও একই। তথাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বাংলাদেশী নিপাকে সে পছন্দ করে। ওদের মধ্যে ভালো সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। তাই নিরবের একান্ত ইচ্ছে, নিপাকেই সে বিয়ে করবে। কিন্তু কোন ভাবেই সে বাবাকে বলতে পরলো না। শুধু এটুকু জানালো বিয়ের দিনটা এক সপ্তাহ পেছানোর জন্য। নিরবের কথায় আখতার চৌধুরী কাওসারকে গিয়ে বিয়েটা এক সপ্তাহ পেছানোর জন্য অনুরোধ করলো। ঘনিষ্ট বন্ধু, এক সপ্তাহ পেছানো তেমন কোন ব্যাপারই ছিলো না। তাই এ শুক্রবারের পরের শুক্রবারেই বিয়ের দিন ধার্য্য করা হলো। দু’বন্ধু আবার আনন্দে মেতে উঠলো, তাদের আনন্দ আর ধরে না। দু’বাসায় তাদের যাতায়াত আরো বেড়ে গেলো। এ দিকে সুরভার ঘুম হারাম হয়ে পড়লো। সময় নষ্ট না করে তার প্রেমিক মফিজকে সব খুলে বললো। তখন মফিজ সুরভাকে বললো, তুমি কি আমাকে নিরবের ফোন নাম্বারটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? সুরভা বললো, চেষ্টা করলে পারবো কারণ, বাবার মোবাইলে নিরবের নাম্বার আছে। তবে তাই করো, তাড়াতাড়ি আমাকে নাম্বারটা ব্যবস্থা করে দাও, দেখবে আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। মফিজের বুদ্ধি মতো সুরভা তার বাবার মোবাইল ফোন থেকে নিরবের নাম্বারটা সংগ্রহ করে মফিজকে দিলো।

মফিজ খবু চালাক চতুর ছিল। জীবনে অনেক বন্ধুকেও সে এভাবে সাহায়তা করেছে। আজ নিজের জীবনের ব্যাপার, সেটা সে করতে পারবে না! ওই দিনই রাতে মফিজ নিরবকে ফোন দিয়ে আকুতি মিনতি করে অনেক বুঝালো। সুরভাকে ছাড়া যে সে বাঁচবে না তা-ই সে নিরবকে বুঝালো। মফিজের ফোন পেয়ে নিরবতো মহা খুশি। কারন, সেতো নিপাকে ভালবাসে। কিন্তু এটা সে বুঝতে না দিয়ে বললো, ভাই আপনারা যেহেতু উভয়ে উভয়কে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন, সেখানে আর কি-ই বা করার আছে! তাছাড়া জোর করেতো আর বিয়ে হয় না! ঠিক আছে আপনি যখন এতো করে বলছেন তবে আমি সরে গেলাম, এ ছাড়া বিয়েতো এখনো হয় নি! এ সব কথা বলে উভয়ে উভয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলো। পরের দিন সকালে মফিজ ‍সুরভাকে সব খুলে বললো, সুরভাতো মহা খুশি। কিন্তু ‍ওদের বাবা/মাকে বুঝাবে কে? এ কথা যদি বাবা জানতে পারে তবে সুরভাকে মেরেই ফেলবে। তাই মফিজ ও সুরভা যুক্তি করলো, বাবা/মাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে, তারা বিয়ে করে ফেলেছে, পরে যা হবার হবে।

অন্য দিকে নিরবও একই কথা ভাবছিলো যে, বাবা কে ফোন করে বলতে হবে, সে নিপাকে বিয়ে করে ফেলেছে। বিয়ের আগের দিন চলে আসলো, কাল বিয়ে। সুরভা নিজের মনকে শক্ত করে, মাকে নিয়ে বাবার রুমে গেলো। বাবা সুরভাকে দেখে বললো কিরে মা কিছু বলবি? সুরভা কিছু না বলে সোজা বাবার পা চেপে ধরলো এবং কান্নাকাটি করে বলতে লাগলো বাবা এ বিয়ে হবে না! আমি মফিজ নামে একটা ছেলেকে ভালবাসি, তাই আজ আমরা বিয়ে করে ফেলেছি, আমাকে মাফ করে দাও বাবা। এ কথা শুনেতো হাজী কাওসার সাহেবের মাথায় বাজ, প্রথমে খুব রেগে গেলো। পরে বললো আমার বন্ধুকে আমি কি জবাব দিবো! পরোক্ষনে, মেয়ের পায়ে পড়ে থাকা ও কান্নাকাটিতে বাপ হয়ে মেনে না নিয়ে আর পারলো না। শুধু বললো, আমাকে তুই অনেক ছোট করে ফেললিরে মা!

অপর দিকে, ইটালী থেকে নিরব ফোন করলো বাবাকে, বাবা হ্যালো বলতেই কেঁদে ফেললো। বাবা আখতার চৌধুরী ছেলের কান্না শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না, শুধু বললো কি হয়েছে বাবা আমাকে খুলে বল? আগে বলো আমাকে মাফ করে দিবে, আমার ওপর রাগ করবে না, তবেই বলবো? অগত্যা আখতার চৌধুরী কথা দিলো। তখন নিরব বলতে লাগলো, বাবা আমি নিপা নামে একটি বাংলাদেশী মেয়েকে অনেকদিন ধরে ভালোবাসি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আজ আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। এ কথা শুনে নিরবের বাবার মাথায়ও কাওসার সাহেবের মতো বাজ পড়লো। এতো দিনের বন্ধুকে সে কি জবাব দেবে, বোধয় সম্পর্কটাই শেষ হয়ে গেলো! কিন্ত ‍কি আর করা শত হলেও ছেলে, তার ওপর বিয়েও করে ফেলেছে। তাই, ছেলের কান্নাকাটি দেখে মাফ না করে আর পারলো না। কিন্তু হাজী কাওসারকে কি বলবে! ফলে, সারা রাত আর ঘুমায়নি। শুধু চিন্তা করেই রাত পার করে দিল। পরে ভাবলো, এতোদিনের বন্ধুত্ব নষ্ট করা যাবে না, যে ভাবেই হউক হাতে পায়ে ধরে হাজী কাওসারের কাছে মাফ চেয়ে নিবে। আজ বিয়ের দিন ধার্য্য ছিলো।

সকাল দশটায় আখতার সাহেব মাফ চাওয়ার জন্য কাওসার সাহেবের বাড়ি গেলো। ভাবী আখতার সাহেবকে ঘরে বসালো, সবারই মন খারাপ। তখন কাওসার সাহেব ওয়াশরুমে ছিলো। ওয়াশরুমের কাজ সেরে এসেই সোজা ড্রয়িংরুমে এসে বন্ধু আখতার সাহেবের হাত চেপে ধরলো। আখতার সাহেব কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়লো। নিজে মাফ চাওয়ার আগেই হাজী কাওসার বললো দোস্ত আমাকে মাফ করে দে, এ বিয়ে হবে না! সুরভা মফিজ নামে একটি ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছে, হাত আর ছাড়ছে না। এ কথা শুনে নিরবের বাবা আখতার চৌধুরী নড়ে চড়ে বসলো, যেমন বাবা তেমন ছেলে! ছেলের মতোই বলে বসলো, মন খারাপ করিস না, সবই আল্লাহর ইচ্ছে, তাছাড়া বিয়েতো আর জোর করে হয় না, দোয়া করি তোর মেয়ে সুখে থাকুক। নিরব যেমন মফিজের কাছে নিপার কথা চাপিয়ে গিয়ে ছিলো, তেমনি আখতার চৌধুরীও ছেলের মতো নিরবের ঘটনা চাপিয়ে গেলো। সুরভা ও তার বাবাই নিরবের বাবার কাছে নিচু হয়ে রইলো।

লেখক: ইন্সপেক্টর (তদন্ত)
পরশুরাম মডেল থানা, ফেনী জেলা।

Comment here