এক্সক্লুসিভজাতীয়সারাদেশ

“মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি”

“মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি”

মোঃ আদিল মাহমূদ

“অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাধ্যমে জীবনী”

পিতা রাজনারায়ন দত্ত ও প্রথমা
পত্নী, জাহ্নবী দেবীর একলা সন্তান
কলকাতার সদর দেওয়ানী খ্যাত,
আদালতের উকিল এক খ্যাতনামা
রাজনারায়ন দত্ত, বাবুজী ছিলেন।
সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ এক পরিবারে,
মহাকবি জন্মে ছিল বিধির বিধান।
সাগর দাঁড়ি যশোরে প্রাণ প্রিয় নাম,
কেশবপুর সুন্দর রম্য উপজেলা।
আঠারশত চম্বিশ সালের পঁচিশে,
সূর্য আসে পৃথিবীতে জানুয়ারী মাসে।
বয়স যখন তের শুরু হয় বাস।
ভারতের কলকাতা হয় আবাসন,
মা জাহ্নবী দেবী তার শিক্ষা হাতে খড়ি।
জননীর কাছে জ্ঞান পায়, রামায়ন,
মহাভারত, পুরান ইত্যাদি সম্পর্কে।
মহাকবি প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে,
মুফতি লুৎফুল হক ইমামের কাছে।
মসজিদের পাশের শেখপুরা গ্রামে,
জ্ঞানগর্ব অতিশয় বিদ্বান ছিলেন।
বাংলা, ফারসী, আরবি শিক্ষা ইমামের
নিকটে বাল্য শিক্ষার তার যাত্রা শুরু।
মাইকেলের সাগর দাঁড়ি বাল্যকাল,
কলিকাতায় আসেন কবি বৎস তের।
স্থানীয় কলেজে পড়া সমাপ্তে তথায়,
হিন্দু কলেজ বিখ্যাত নামে খ্যাত যাহা
বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়,
মহাকবির ভর্তির ,পড়া শুরু হয়।
ভর্তি ও মেধার গুনে তিনি সুমহান
মুধুসূদন, কলেজে অধ্যক্ষের প্রিয়
হয়ে উঠেন। অধ্যক্ষ,ভালবাসতেন,
ডি,এল, রিচার্ডসন দত্তের প্রাণের
প্রীতি সঞ্চার করতে ছিলেন নিরবে।
ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন ছিলেন প্রেমিক,
মহা ক্যাব্যে ছিল তার আশ্চর্য তপস্যা,
তার কাছ থেকে শিক্ষা পান কাব্য প্রীতি।
আরো কিছু স্মৃতি, কবি উদ্বুদ্ধ হতেন।
হিন্দু কলেজের পূর্ব শিক্ষক পন্ডিত
নামক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগে,
স্মৃতি মহা কবিকেও প্রভাবিত করে।
আঠার বছর ধরে কবির ভিতর,
যুক্তরাজ্য যাওয়ার উচ্চকাঙ্খা আসে।
কৃষ্ণমোহন অতিব জ্ঞানী লোক ছিলো।
মাইকেল উপস্থিত করে তার কাছে,
খ্রিষ্টধর্ম গ্রহনের ইচ্ছা মন থেকে।
আঠারশত সনের তেতাল্লিশ সাল,
তের ফেব্রুয়ারী রোড মিশন ঐ বৎসে,
চাট নামে খ্যাত ওল্ড মিশন দত্তের
ধর্মগুরু, অ্যাংলিক্যান চার্চে মাইকেল
উপাধী,পাদ্রী ডিলট্রি তাকে দিয়ে যান।
ফলশ্রতিতে, ধরাতে কবি প্রচারিত,
মধুসুদন দত্তের মাইকেল নাম।
বরেন্দ্র মধুসুদন, বাঙলা ভাষায়
সনেট, অমিত্রাক্ষর ছন্দের নির্মাতা।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের রামায়ন মহা
উপাক্ষান অনুসারে, রচিত কাব্যের
মেঘনাদবধ, তার সর্বশ্রেষ্ট র্কীতি।
মধুসুদনের অন্য লক্ষণীয় যোগ্য
লেখনী হচ্ছে, একেই কি বলে সভ্যতা,
শর্মিষ্টা কবিতাবলী, চতুর্দশ পদি,
হেকটর বধ ও দ্যা ক্যাপটিভ লেডি,
বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ও পদ্মাবতী,
বীরাঙ্গনা কাব্য গ্রন্থ, ব্রজাঙ্গনা কাব্য,
কৃষ্ণ কুমারী নাটক এবং তিলোত্তমা
সম্ভব ইত্যাদি। তার জীবনের ছিল
বহুবিধ নাটকীয় এবং বেদনার।
উনপঞ্চাশ বছর বয়সের কবি
মৃত্যুবরণ করেন,স্হান কলকাতা।
মহাকবির খ্রীষ্টিয় ধর্মে ধর্মান্তর,
তৎকালীন সমাজের মধ্যে আলোড়ন
সৃষ্টি করেছিল, যেটা অনেকে মানতে
পারেনি, ফলশ্রুতিতে রাজনারায়ন
দত্ত, বিধর্মী পুত্রকে নিজে ত্যাজ্য পুত্র
ঘোষনা করেন। ফলে, খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা
পরে, পাশ্চাত্য সাহিত্যে আর্কষণ বশে
ইংরেজী ভাষায় কাব্য,সাহিত্য গড়নে
মনো নিবেশ করেন ও তৎপর হন।
প্রাণের দ্বিতীয় পর্বে তিনি সিদ্ধান্তের
মাধ্যমে নিজের মাতৃ ভাষার উপর
জোর দেন, ক্ষনে তিনি বাংলায় নাটক,
প্রহসন, কাব্য লেখা রচনা করেন।
ফলে, তাকেই বাংলার নবজাগরণ
সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব
গণ্য করা হয়। বাংলা আধুনিক কাব্যে
প্রথম বিদ্রোহী কবি নামে সমাদৃত।
খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের পর মাইকেল
শিবপুরে, বিশপস কলেজের হাতে
পড়া লেখা অগ্রে নেন। তদন্তে এখান
থেকে কবি গ্রিক এবং লাতিন, সংস্কৃত
প্রভূত ভাষা নিজের আয়ত্বে আনেন।
পিতা তাকে পরিত্যাগ করলেও তিনি
পান্ডিত্ব চালিয়ে যেতে সক্ষমতা পান।
কারণ, প্রিয় বাবুজী, পরবর্তী কালে
চার বৎসর পর্যন্ত দত্তের দায়িত্ব
পালন করেন এবং খরচ পাঠান।
বিশপস কলেজের অধ্যয়ন শেষে
মহাকবি মাইকেল,তথায় চাকুরী
করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি তথা
ব্যর্থ হলে বিশপস কলেজের বন্ধু
মাদ্রাজী কয়েক জন ছাত্র সহায়তা
করেন এবং তাদের সঙ্গেই মাদ্রাজ
চলে যান। বলা অতি বাহুল্য গোপনে
নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে পরে,
সেই টাকায় চেন্নাই চলে গিয়েছেন।
মাদ্রাজে মদুসূদন ইংরেজের দ্বারা
সহায়তায়, একটি স্কুলেতে ইংরেজী
শিক্ষার চাকুরী নেন। খ্রীষ্টান লোকরা
চাকুরীর সহায়তা করেন পেছনে।
কিন্তু অর্জিত বেতনে খরচ মোচন
কোন উপায়ে সম্ভব ছিলনা বিধায়,
পত্রিকায় লেখা লেখি বিস্তারিত শুরু
করেন। এই সময় কবি ছদ্মনাম
ব্যবহার করতেন এবং ক্রনিকল
পত্রিকা মাদ্রাজে তার কবিতা প্রকাশ
হতে থাকে। পরবর্তী কালে তিনি এক
হিন্দু ক্রনিকল নামে পত্রে সম্পাদক
ছিলেন। কিন্তু অদৃষ্ট খারাপ থাকায়,
ক্ষন কালে অর্থাভাবে পত্র ও পত্রিকা
ছাপা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, খ্যাতিমান
মহাকবিকে কঠিন অর্থের সংকটে
পড়তে হয়। তখন তার ছিল মাত্র
পঁচিশ বৎসর কাল। দারিদ্রের মাঝে
মহান কবির হাতে, ক্যাপটিভ লেডি
প্রথম কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে অভিজ্ঞ
মাইকেলের সর্বত্র নাম আলোড়ন
সৃষ্টি করে। এতে তিনি পুলকিত হন।
মাদ্রাজ থাকাবস্থায় লেখক রেবেকা
ম্যাকিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতী
বিয়ে করেন। বছর আট উভয়ের
দাম্পত্যজীবন সুখি ও সুন্দর ভাবে
চলছিল। এ সংসারে কবির তনয়
দুই এবং দুই কন্যা জন্ম লাভ করে।
শেষের দিকে মাদ্রাজ বসবাস কালে
দত্ত ফরাসী তরুনী জায়া এমিলিয়া
হেনরিসেটাকে বিয়ে করেন। তথায়
পরে মাইকেল তার কাব্যের সুন্দর
একটি কপি, সবাক গৌরদাস নামে
এক বন্ধুকে সন্মানী উপহার দেন।
গৌরদাস বসাকও সেটিকে আবার
জে,ই,ডি বেথুন এর কাছে উপহার
হিসেবে প্রেরণ করে। কাব্যের লেখনী
পাঠে অতি মুগ্ধ হয়ে বেথুন কবিকে
পত্র লিখে দেশে ফিরে বাংলায় রচনা
করতে সম্মতি দেন। তাই মূল্যায়ন
থাকায়, আঠারশত ছাপ্পান্নের সালে
পত্মীকে তথায় রেখে কলকাতা ফিরে
আসেন এবং সেথায় মনোযোগী হন।
মাইকেল পড়ালেখা মূলত ইংল্যান্ডে
করতে গিয়েছিলেন। আইন বিষয়ে
তথাকার পরিবেশ এবং বর্ণবাদ
মহাকবির পছন্দ ছিল না বিধায়,
আঠারশত ষাটের সময় ভার্সাই
যান। ভার্সাই ফ্রান্সের অর্ন্তগত ছিল।
কিন্তু আর্থিক অবস্থা উন্নত ছিল না।
হিতৌষী ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের
জন্য তাহার তথায়, আইন সংক্রান্তে
পড়া শেষে কলকাতা আসতে সক্ষম
হয়েছেন। কিন্তু তিনি তার সব জ্ঞান
কলকাতায় জাহির করেনি, বরঞ্চ
অভাব তার মৃত্যুর প্রধান কারণ।
মধুসূদন ছিলেন বিজ্ঞ মহাকবি,
একাধারে ভাষাবিদ। ছোট্ট শিশু কালে
ফারসি শিক্ষার ভাষা শুরু গ্রাম থেকে।
তিনি ইংরেজী ছাড়াও ল্যাটিন, ফারসি
হিব্রু, তেলেগু, তামিল, গ্রীক এই সব
ভাষায় সহজে কথা বলতে শিখেন।
ফারসী ও ইতালীয় ভাষায় কবিতা
লিখতে এবং পড়তে পারতেন। বরং
তিনি অন্যান্য বারোটি ভাষা জানতেন।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের
সাহিত্য প্রেম জাগ্রত করতে, লেখক
বায়রনের সাহিত্য কর্মপন্থা মনে
অনুসরন করেন। বায়রন দক্ষ
ইংরেজ কবি হলেও মাইকেল তাঁর
প্রেরণায় মহাকাব্য মেঘনাদবধ
দ্রুত প্রকাশ করতে পেরেছেন। তার
ফলে মাইকেল বাংলা ভাষায় পূর্নতা
লাভ ও সাহিত্যে নিজে স্বতন্ত্র হিসেবে
বিকশিত হওয়ার পরিপূর্ণ ভাবে
মর্যাদা পেয়ে ছিলেন। এই অবস্থায়
হোসেরিক স্টাইলের প্রথম রচনা
তিনি প্রবর্তন শুরু করেন। তথাপি
আঠারশত বায়ান্ন সালে শিকদার
তারাচরণ গুপ্ত ও জে.সি তর্করত্ন
রায় নারায়ন এর পথ ধরে, বাংলা
রঙ্গমঞ্চে মঞ্চায়ন করেন নাট্যের।
যদিও শুরু করেন, বাংলা নাটকের
মধ্যে আসা তার জন্য সহসা অবাক
করা আর্বিভাব ছিল। এরপর তিনি
নিজে নাট্য রচনায় অধিক ব্রতী
হন। এ নাট্যচর্চায় কবি মাইকেল
ইশ্চরচন্দ্র সিংহের ও প্রতাপচন্দ্র
সিংহের গৌরভ সহ পাইকপাড়ার
সমাদৃত জমিদার এ দুই জনের
পৃষ্টপোষকতা কবি উৎসাহিত হন।
তথায় বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে দুই
জমিদার মঞ্চায়িত করেন নাটক।
রাম নারায়ন তর্ক রত্নের নাটক
রত্নাবলী দেখে কবি খুবই ব্যথিত।
এতে জমিদারদের অনেক খরচ
অর্থ ব্যয় হয় কিন্তু সফল হয়নি।
মধুসূদনের শেষ জীবন কার্যত
দুঃখে অতিক্রান্ত হয়। কবির আইন
ব্যবসা ও সফলতা পায়নি, বরঞ্চ
অমিতব্যয়ীতা তাকে স্বভাবে অনেক
ঋনগ্রস্ত করে তোলে। উনত্রিশ জুন,
এই খ্যাতনামা কবি খুব অর্থাভাবে,
আলিপুর জেনারেল হাসপাতালের
শয্যায়, জন্ম ভুমির প্রতি ভালবাসা
রেখে অষ্টাদশশত তিয়াত্তর সালে
সর্বশেষ নিজ প্রাণ বিয়োগ করেন।

লেখক: ওসি (তদন্ত)
পরশুরাম মডেল থানা, ফেনী জেলা।

Comment here