সারাদেশ

সড়ক পরিবহন আইন আজ থেকে কার্যকর


নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার প্রায় ১৩ মাস পর আজ থেকে কার্যকর হচ্ছে বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’। আইনটি কার্যকরে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণাসহ আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে বিধি প্রণয়ন ছাড়াই কার্যকর করতে যাওয়ায় আইনটির সুফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। পাশাপাশি দুর্ঘটনার মামলাকে জামিনযোগ্য করাসহ কয়েকটি ধারায় সংশোধন আনারও দাবি তুলেছেন তারা।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত বছরের জুলাইয়ে রাজধানীজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। ওই বছরের ৮ অক্টোবর আইনটির গেজেট প্রকাশিত হয়। এর ১১ মাস পর গত ২৩ অক্টোবর আইনের গেজেট প্রকাশ করা হয়। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গেজেটে বলা হয়েছে, সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা ১-এর উপধারা (২)-এ দেয়া ক্ষমতাবলে সরকার ১ নভেম্বর তারিখকে আইন কার্যকর হওয়ার তারিখ নির্ধারণ করল।

আইন কার্যকরের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) লোকমান হোসেন মোল্লা বণিক বার্তাকে বলেন, অনেক দিন ধরেই আমরা আইনটি কার্যকরের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরই মধ্যে আইনটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিতরণ করা হয়েছে সচেতনতামূলক লিফলেট। আইনটি কার্যকরের জন্য আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত।

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, গাড়ির লাইসেন্স না থাকলে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। ভুয়া লাইসেন্সের জন্য শাস্তি আরো বেশি। সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির জন্য সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন ধারায় ট্রাফিক আইন অমান্যের জন্য বাড়ানো হয়েছে শাস্তি ও জরিমানা।

লাইসেন্সে থাকবে মোট ১২ পয়েন্ট। বিভিন্ন বিধি অমান্যে কাটা যাবে এ পয়েন্ট। পয়েন্ট শূন্য হলে বাতিল হবে চালকের লাইসেন্স। দুর্ঘটনার জন্য শাস্তি দেয়া হবে দণ্ডবিধি অনুযায়ী। নরহত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড। হত্যা না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪ (বি) ধারা অনুযায়ী তিন বছরের কারাদণ্ড হবে।

সরকারের হিসাবেই গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৫ হাজার ৫২৬ মানুষ। আহত হয়েছে ১৯ হাজার ৭৬৩ জন। এ হিসাবে প্রতি বছর গড়ে আড়াই হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। গত ১২ জুন জাতীয় সংসদে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের এ পরিসংখ্যান দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী।

তবে বেসরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, গত চার বছরেই (২০১৫-১৮) সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৯ হাজারের বেশি মানুষ।

আগের আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। নতুন আইনে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য চালকের কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পাসের শর্ত রাখা হয়েছে। একইভাবে চালকের সহকারীর পঞ্চম শ্রেণী পাসের সার্টিফিকেট থাকার কথা বলা হয়েছে।

নতুন আইনে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। আগের আইনে এ অপরাধের জন্য তিন মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল।

নতুন আইনে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না চালক। এ আইন ভাঙলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে—এমন অপরাধের ক্ষেত্রে চালককে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে পুলিশকে।

নতুন আইনে সড়ক দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। আইনের ১০৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, মোটরযান চলাচলজনিত দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সেটি ১৮৬০ সালের পেনাল কোড অনুযায়ী অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। আইনটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ১০৫ নম্বর ধারার অপরাধ জামিন অযোগ্য করা।

মূলত এ জায়গাটিতেই আপত্তি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের। গত বছরের অক্টোবরে আইনটির গেজেট প্রকাশের পর থেকেই শাস্তি কমানো, জামিনযোগ্য করা, অর্থদণ্ড বাতিলসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে আসছিলেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।

গতকাল এসব বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনও হয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ব্যানারে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, আমরা নতুন আইনটি স্বাগত জানাই। এটি বাস্তবায়নের বিরোধিতাও আমরা করছি না।

তবে আইনটিতে কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্য রয়েছে। দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু কোনো চালক তো কখনো ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটায় না। তাহলে দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে সেই অপরাধে কেন হত্যাকাণ্ডের শাস্তি পেতে হবে? আমরা চাই, দুর্ঘটনার মামলা যেন ৩০২ ধারায় না হয়। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয়, ড্রাইভার কাউকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হত্যা করেছে, সেক্ষেত্রে মামলাটি পরে ৩০২ ধারায় স্থানান্তর হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু দুর্ঘটনাকে হত্যা মামলা বলে চালিয়ে দেয়া হলে আমরা প্রতিবাদ করব। লিখিত বক্তব্যে তিনি দুর্ঘটনার মামলাকে জামিনযোগ্য করা, কয়েকটি ধারা সংশোধনসহ পাঁচটি দাবি জানিয়েছেন।

Comment here