এক্সক্লুসিভসারাদেশ

“অভিমান মূল্যহীন” মোঃ আদিল মাহমুদ

“অভিমান মূল্যহীন” মোঃ আদিল মাহমুদ

“অভিমান মূল্যহীন”

মোঃ আদিল মাহমুদ :

জাফর মেধাবী ছাত্র। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স পাস করেছে। তার অনেক ইচ্ছে ছিলো আমেরিকায় গিয়ে পড়াশুনা করবে। কিন্তু ভাগ্যে ছিলনা, তাছাড়া বাবারও আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিলো না। তারপরেও বাবার সহযোগিতায় কয়েবার আমেরিকান দূতাবাসে ভিসার জন্য চেষ্টা করেছিল। দুইবার TOEFLপরীক্ষা দিয়ে বাবার সহায়তায় আমেরিকার দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে I-20ও এনেছিলো। কিন্তু জাফরের অদৃষ্ট মন্দ ছিলো, যাওয়া হলো না স্বপ্নপুরী। দূতাবাস, পর্যাপ্ত ব্যাংক সলভেন্সি না থাকায়, তাকে ভিসা দিতে অপারগতা জানায়।

আমেরিকার ভিসা না হওয়ায় জাফরের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে যায়। বাবা ছিল তার প্রিয় বন্ধু, তাই বাবার উৎসাহ ও উদ্দীপনায় অনার্সে ভর্তি হয় এবং সাফল্যের সাথে পাস করে। কিন্তু পাস করলে কি হবে চাকুরীতো চাই! চাকুরীতো আর এতো সোজা না, তার জন্য আরো পড়াশুনা করতে হবে! বিধায়, বাবার সহযোগিতায় বি,সি,এস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করে। তাকে বি,সি,এস এর প্রস্তুতি নেয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে ছিলো তার বন্ধু বাবা।

ঢাকার শাহজাহানপুরে, বেনজির বাগান বাড়িতে একটি চার তলা বিল্ডিং এর চার তলায় ভাড়া থাকতো জাফর। পড়াশুনার জন্য বাবা তাকে ডান পাশের সুন্দর একটি রুম ছেড়ে দেয়। সময় মতো রুমে দুধ ও ডিম আসতো। ছেলে পড়াশুনা করছে বলে বাবা-মার আনন্দের সীমা নাই। জাফরও পুরোদমে বি,সি,এস এর জন্য পড়াশুনা শুরু করলো। প্রথম চয়েস দিয়েছিল পুলিশ ও দ্বিতীয় প্রশাসন ক্যাডার। প্রথমে একবারেই জাফর ভায়ভাতে পৌঁছেছিলো, প্রথমে, প্রিলিমিনারী, তারপর লিখিত, পরে মনস্তাত্মিক সব পাস করেই ভায়ভাতে যেতে হয়। কিন্তু ভাগ্য হয়তো অপ্রসন্ন ছিলো কিংবা ভায়ভা ভালো হয়নি সব মিলিয়ে এবারের বি,সি,এস- এ জাফরের পাস করা হলো না। কিন্তু সাহস যুগিয়েছে বাবা, বলতো একবার হয়নিতো কি হয়েছে পরের বার হবে, মন খারাপ করার কিছুই নাই, দেখবে পরের বার ঠিকই তোমার হয়ে যাবে।

জাফর যে রুমে বসে পড়াশুনা করতো, সে রুমের মধ্যেই তার টেবিলের বাম দিকেই জানালা ছিলো। ঐ জানালা দিয়ে পাশের বিল্ডিং এর বাড়ান্দা দেখো যেতো। এতাদিন জাফর খেয়াল করেনি। একদিন হঠাৎ দেখে বাড়ান্দায় একটি মেয়ে চুল খুলে বসে আছে। এভাবে কয়েকদিনই জাফর তা দেখতে লাগলো। জাফর যেমনই ছিলো তবে, লাজুক ছিলো। পড়ার চাপও একটু কম ছিলো, তাই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাড়ান্দায় বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকাতো। মেয়েটি অনেক ভদ্র ছিলো, জাফর যে ইদানিং প্রায়শই মেয়েটির দিকে তাকায় এতে মেয়েটি একটু অশ্বস্তিবোধ করতে লাগলো। এদিকে জাফরের পড়ার ব্যাঘাতও ঘটতে শুরু করলো।

মেয়েটির কলেজ ড্রেস দেখে বুঝা যেতো যে, সে সম্ভবত: মতিঝিল আইডিয়ালে পড়তো। মেয়েটিও কেমান যেনো ছিলো! দেখতে ছিলো অপূর্ব, তবে সেটা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে মেয়েটিও কলেজ থেকে এসে কলেজ ব্যাগটা ঘরে রেখেই বাড়ান্দায় এসে জাফরের বরাবরই চেয়ার নিয়ে বসতো। এতে জাফরের মনে হতো হয়তো মেয়েটি জাফরের তাকানোকে পছন্দ করতো। তাই জাফর আরো বেশী করে তাকাতো।

জাফর ছিল ওখানের ভাড়াটিয়া, আর মেয়েটি যে বাড়িওয়ালীর মেয়ে ছিলো তাতে কোন সন্দেহ ছিলো না। কারন, মাঝে মধ্যে মেয়েটির এ বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিং এর মেয়েদের সাথে কথা বলা দেখেই জাফর আঁচ করতে পেরেছিলো। এলাকায়তো আবার বাড়িওয়ালাদের প্রভাব বেশী থাকতো। তাই জাফর মাঝে মধ্যে ভয়ও পেতো। কিন্তু মেয়েটির তাকানো ও বসা-বসির কারনে জাফরের মনে হলো যে, ভয়ের কিছু নেই। কারন, নিশ্চয়ই মেয়েটি তার তাকানো কে পছন্দ করে। এই ভাবে চোখের দেখায় ৮/৯ মাস পার হয়ে গেলো। এখন জাফর অপেক্ষায় থাকতো কখন মেয়েটি বাড়ান্দায় আসবে।

যদি কোনদিন মেয়েটি বাড়ান্দায় না আসতো তখন জাফরের মন খারাপ হলেও সে বুঝতো মেয়েটি বাসায় নেই। কারন, জাফরের ধারনা এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে, মেয়েটি তাকে পছন্দ করে এবং তা-ই মনে হচ্ছিলো। মেয়েটি এসেই, বাড়ান্দায় হাজির এবং চিৎকার করে, কালো করে একটি কাজের মেয়ে ছিলো তাকে বলতো চেয়ার নিয়া আয়। জাফর ঘরের ভিতরে থাকলেও বুঝতে পারতো ও এসেছে। জাফরের মনে হতো জাফরকে উদ্দেশ্য করেই মেয়েটি চিৎকার করে চেয়ার আনতে বলতো। তাই জাফর সব কিছু ফেলে দৌঁড়ে জানালার কাছে আসতো। সহজ সরল জাফর দিন দিন মেয়েটির প্রতি দুর্বল হতে লাগলো। মাঝে মধ্যে মেয়েটি দু’একটি বান্ধবী নিয়ে এসেও বাড়ান্দায় বসতো। জাফর তখন খুব অস্বস্তি ফিল করতো, একেতো বাড়িওয়ালীর মেয়ে তার উপর বান্ধবী। তাই, ভয়ে আস্তে তাকাতো। কিন্তু জাফরের মনে হলো ওর বান্ধবীরা ব্যাপারটা জানে, কারন সবাই জাফরকে ফলো করতো।

এভাবে চলতে লাগলো, আবার বি,সি,এস পরীক্ষাও কাছা কাছি চলে এলো। কিন্তু কি অদৃশ্য খেলা! জাফর পড়ায় তার মনই বসাতে পারছিলো না। মনে হচ্ছিলো, তার ভালোবাসা তাকে ডাকছে। জাফররের জানালা ও পড়ার টেবিল থেকে মেয়েটির বাসার সব দেখা যেতো। বাসায়ও মেয়েটি খুব প্রভাবশীল ছিলো। কারন, সমসাময়িক একটি ছোট বোন ছিলো, ওকে প্রায়শই ধমকের সুরে কথা বলতো। তাছাড়া ও যখন ঘন্টার পর ঘন্টা বাড়ান্দায় রৌদ্রের মধ্যেও বসে থাকতো তথনও ওর বাবা/মা ওকে কিছু বলতো না। তবে, ইদানিং ওদের কাজের মেয়েটা এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। এরই মাঝে জাফর কিছু কিছু পড়তে লাগলো। আগে রুমের দরজা খোলা রেখে পড়তো, আর এখন বন্ধ করে পড়ে। বাবা/মা ভাবতো জাফর অনেক পড়াশুনা করছে তাই তাদের আনন্দের সীমা নাই। কিন্তু জাফর কি করছে, সেটা জাফরই ভালো যানতো! একমিনিট পড়লে, দশ মিনিট মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতো।

ঐ পাড়ার স্থানীয় একটি মাস্তান জাফরের বন্ধু ছিলো। ওরা এখানে স্থানীয় হলেও দেশের বাড়ি জাফরের বাড়ির পাশেই ছিলো। তাই জাফরের কিছুটা ভরসা ছিলো। একদিনতো বিপদেই পড়ে গেলো, জাফরও ওর দিকে তাকিয়ে আছে, সে কাজের মেয়ে সহ জাফরের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ দেখে ওর ছোট বোনটা ছাদ থেকে জাফরদের ছাদে কার সাথে যেনো জগড়া করছে। ভাল করে না বুঝলেও পরে বুঝতে পারলো জাফরের ছোট বোনের সাথেই ঝগড়া করছে। তখন জাফর ছাদে গিয়ে ছোট বোনটাকে নিয়ে আসে এবং জানালা দিয়ে ওর কাছে হাত জোড় করে মাফ চায়।

প্রায় এক বৎসর পার হতে চললো, জাফর একশত ভাগ কানর্ফাম হলো যে, মেয়েটিও জাফরকে ভালবেসে ফেলেছে। জাফরের জানালা দিয়ে মেয়েটির শোভার খাঁটটা পর্যন্ত দেখা যেতো। শাহজাহানপুর বেনজির বাগান বাড়ি, অনেক বিল্ডিং, চারিদিকেই মানুষ দেখা যায়। একদিন মেয়েটি বসে জাফরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কালো কাজের মেয়েটি পাশেই দাড়ানো ছিল। তখন বেলা চারটা হবে, জাফর সাহস করে এই প্রথম একটি গোলাপ ফুল মেয়েটিকে দেখোলো। মেয়েটিও দেখলো কাজের মেয়েটিও দেখলো কিন্তু হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ চমকালো, কাজের মেয়েটি পায়ের স্যন্ডেল খুলে জাফর কে দেখালো। জাফর লজ্জা স্মরমে অস্থির হয়ে পড়লো। ভাবলো মেয়েটি কাজের মেয়েকে বকা দিবে। কিন্তু না, সে নিশ্চুপ হয়ে রইলো এবং হাসলো। এতে জাফর খুবই মর্মাহত হলো, তিনদিন সে জানালার পাশে আসে নাই। কিন্তু দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখতো ও আছে কিনা। কিন্তু আশ্চর্য্য ব্যাপার ও ঠিকই গালে হাত দিয়ে এক দৃষ্টিতে জাফরের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতো। জাফর কিছুই বুঝতে পারছিলো না। কি ঘটানা কল্পনায়ও সমাধান আসছিলো না।

জাফর আর পারলো না পুনরায় জানালায় আসলো। জাফরের আসাতে মেয়েটি যেনো অনেক খুশিই হলো। তবে কেনো এমন হচ্ছে, জাফর ভাবলো হয়তো বা কাজের মেয়ে ভুল করেছে, ওর কিছুই করার ছিলো না। তাই আবার একদিন সুযোগ বুঝে কাজের মেয়ে না থাকায়, ওকে আরেকটি গোলাপ ফুল সাধলো। মেয়েটি নিবে কিনা কিছুই বুঝালো না তবে একটু হাসলো। এতে আবার জাফর কিছুটা সাহস পেলো। এভাবেই দুই বৎসর পার হলো। মেয়েদের বাসার সবাইকে জাফর চিনে কিন্তু কারোই নাম জানেনা। একপর্যায়ে এসে মেয়েটি শুধু জাফরের জন্য বাড়ান্দায় বসে থাকতো তা প্রমাণিত হলো। কারন, এখন আকার ইংগিতে ওদের কথা হতো। মজার ব্যাপার হলো, জাফর গালে হাত দিলে মেয়েটিও গালে হাত দিতো, জাফর নাক ধরলে মেয়েটি নাক ধরতে, কান ধরলে, ও কান ধরতো। তাই, যখনই জাফর ওর হাতের আঙ্গুল দিয়ে মেয়েটিকে ফ্লাইং কিস দিতো তখন সে নিশ্চুপ হয়ে যেতো। রাতে ঘুমানো পর্যন্ত ওদের এই ভালোবাসা চলতে থাকলো।

একদিন ঘুমানোর সময় মেয়েটি জাফরকে ইংগিত করে বললো যেনো থাকে সে গোসল করে আসবে। জাফরও জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো। একসময় গোসল সেরে এসে সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজলো। জাফর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। প্রায়দিনই এভাবে চলতো কিন্তু কোনদিনও সরাসরি তাদের কথা হয়নি। মেয়েটি জাফরের কথা কখনো শুনেনি। কিন্তু জাফর তার সব কথা শুনতো, সে জাফরকে শুনিয়েই সব বলতো। ওর সব বান্ধবীরাই ব্যাপারটা জানতো। একদিন রাতে ও জাফরকে দেখিয়ে সাঁজতে ছিলো, তখন জাফর ওকে হাত দিয়ে বুঝালো, চলো আমরা পালিয়ে যাই। উত্তরে মেয়েটি এক হাতের উপর অন্য হাত উঠিয়ে বুঝালো তার হাত বাঁধা। মাঝে মধ্যে সুন্দর শাড়ী দেখিয়ে ওকে বউ বানানোর কথা বুঝাতো। কিন্তু তার যে মন খারাপ হতো তা জাফর বুঝতো। কিন্তু কোথায় যেনো একটা সমস্যা কাজ করছিলো তা ভালভাবে বুঝতে পারছিলো না জাফর। ইদানিং কালো মেয়েটিও জাফরকে দেখে কিন্তু এখন আর জুতা দেখায় না।

সর্ম্পকটা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে, জাফর যদি কোন দিন বাহিরে থাকতো তবে জাফর বুঝতো যে, মেয়েটি জাফরের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কোন দিন রাত দই টার সময় এসেও দেখতো সে দরজা খুলে খাঁটে বসে আছে এবং জাফরকে ধমকের সুরে বুঝাতে চাইতো এতো রাতে কি করেছে? মাঝে মধ্যে রাগ করে দরজা বন্ধ করে দিতো, আবার অনেক্ষন পর খুলতো এবং হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতো। কোন গবেষক এসেও যদি পরীক্ষা করতো তবে দেখতো যে জাফর ও মেয়েটির সম্পর্ক গভীর পর্যায়ে পৌঁছেছে। কারন, কেউই কাউকে না দেখলে থাকতে পারতো না। একদিন শুধু শাহজাহানপুর বাজারে বাজার করতে গিয়ে ঐ কালো মেয়েটির সাথে জাফরের দেখা। জাফরতো ভয়ই পেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি জাফরকে দেখে হঠাৎ করে বললো, আপামনি বলেছে আপনি নাকি অনেক ভালো। কিন্তু মেয়েটির সাথে বাড়িওয়ালী ছিল, তাছাড়া মেয়েটিকে জাফর বিশ্বাসও করতে পারছিলো না।
। সব মিলিয়ে চোরাবালী ছাড়া আর কিছুই না!

স্যন্ডেল দেখানোর পর থেকে জাফর খুব ভয় পেতো, কোন কিছুই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলো না। বার বার জাফরের মনে হতো ও হাত বাঁধা বলতে কি বুঝাতো! তাই, একদিন ওকে দেখিয়ে কাগজ দিয়ে কয়েকটি লাভ বানালো ও একটি চিরকুট লিখে জানালা দিয়ে নিচে ফেললো। ও কাজের মেয়েটিকে দিয়ে ওগুলো নেওয়ালো। চিরকুটে শুধু লিখা ছিলো, “আমি জাফর, ভালোবাসি কিনা তুমি ভালো জানো, আজোও তোমার নামটা জানা হলো না, যদি পারো কিছু জানিও”।

ভয়ে বেশ কিছু লিখাও যাচ্ছিলো না। কারণ, যদি অন্যের হাতে পড়ে তাই, ওর বাসার ঠিকানা জাফরের জানা ছিলো। কারণ, বাড়ির সামনে দিয়ে যখন জাফর যেতো, দেখতে দেখতে বাড়ির নাম্বারটা মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। এরই মাঝে বি,সি,এস পরীক্ষায় আবারো জাফর ভায়ভা পর্যন্ত গেলো কিন্তু তেমন ভালো হয়নি। এভাবে কি আর পড়া যায়? এবার ভাবলো আর এভাবে থাকা যায় না, ওকে কিছু বলা দরকার। তাই একদিন রাতে আবারো শেষ বারের মতো ওকে জাফরের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে বললো। কিন্তু আগের মতোই ও বুঝিয়ে ছিলো ওর হাত বাঁধা, সম্ভব না। আগেই বলেছি, জাফর বেনজির বাগান বাড়ি, শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনীর চার তলার ভাড়টিয়া, আর ওরা ওখানকার বাড়িওয়ালি, ঝামেলা হলে জাফরের পক্ষে একজন ছাড়া আর কেউ থাকবে না। তাই বেশি বেশি চিন্তা করতে লাগলো কি করা যায়, বা কি করা উচিৎ!

একদিন ভোরবেলা জাফর ঘুমে, মা এসে জাফরকে জানালো ৮/১০টি ছেলে এসেছে তোর সাথে কথা বলবে। জাফর উঠলো কিছুটা ভয়ও পেলো। তারপরেও ‍ওদেরকে ভেতরে নিয়ে বসালো। যেখানে তাদেরকে বসানো হলো সেখান থেকে জানালা দিয়ে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছিল। জাফরের মাস্তান বন্ধু কথা শুরু করলো, বললো জাফর ভাই একটা কথা না বলেই পারছিনা। আপনার জন্য একটি সুখের সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। জাফরতো শুনে অবাক? কি এমন ঘটনা জাফরের জন্য একটি সুখের সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে! বললো জাফর, আমি কি এমন ভুল করছি বলো। এমন সময় একজন ভদ্রলোক ওঠে এসে জাফরের হাত ধরে কেঁদে ফেললো। জাফর ওনাকে শান্তনা দিয়ে বললো কি হয়েছে ভাই আমাকে খুলে বলুন। তখন মাস্তান বন্ধু বললো, আপনি ঐ-যে মেয়েটিকে ভালবাসেন এবং সেও আপনাকে ভালবাসে! ঐ মেয়েটিই এই ভদ্রলোকের আপন খালাতো বোন এবং আজ থেকে পাচঁ বৎসর আগে ওদের বিয়েও হয়েছে, ওদের একটি চার বৎসরের কন্যা সন্তানও আছে। এই কথা শুনে জাফরের মাথা ঘুরে গেলো। আকাশ থেকে যেনো ওর মাথায় পাথর পড়লো। কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে জাফর বললো, আমাকে ক্ষমা করবেন। এই তিন বৎসরে আমি একবারের জন্যও জানতে পারিনি ও বিবাহিতা! জাফরের সমস্ত অভিমান গিয়ে পড়লো ওর উপর। এই কথাটা তো ও জাফরকে খুলে বলতে পারতো! তাছাড়া ওর মেয়েটাকেও তো একবার দেখাতে পারতো! শুধু বুঝাতো হাত বাঁধা।

এই বাঁধা দ্বারা কি কোন বিজ্ঞ লোকের পক্ষ বুঝা সম্ভব ও বিবাহিতা! তাই, ওর উপর রাগ করে ওর নামটাও জানতে চাইলো না জাফর। শুধু বললো, ভাই আমার ভুল হয়েছে, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমি বেঁচে থাকতে আপনার সুখের সংসার নষ্ট হতে দিবো না, ওনি জাফরের হাতই ছাড়ছিলো না। জাফর ওনার কান্না দেখে জাফরের চোখকে ধরে রাখতে পারলো না। তখন সম্ভবত: মাসের দশ তারিখ, তাই জাফর সবাইকে কথা দিলো আগামী মাসের এক তারিখ বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। বাড়িওয়ালাকে বাসা ছাড়ার কথাও বলা হলো। বাবাকে বলা হলো এখান থাকলে বি, সি,এস পাস করা হবে না, হয়তো বাবা কিছু বঝেছিলো! জানালা চির দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো। মাঝে মধ্যে উকি দিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতো, মেয়েটি মাথা গ্রীলে ফেলে বাড়ান্দায় জাফরের অপেক্ষা করছে।

কিন্তু জাফরের কি দোষ বলুন? জাফরতো আর জানতো না ও বিবাহিতা। যতি জানতো তবে ওর বি, সি,এসও হয়ে যেতো। ওকে ভালোবেসে বাবার একমাত্র আশা-বি,সি,এসও হারালো। তাই, নিয়ম মাফিক পরের মাসেই জাফররা বাসা ছেড়ে, মগবাজারে একটি ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলো। জাফর আর কোনদিনও বেনজির বাগান বাড়ি যায় নি, কিন্তু সে তাকে ভুলতেও পারেনি এবং পড়াশোনাও আর করেনি। তাইতো পরের মাসে যখন জাফরের ছোট একটি চাকুরী হয়, তখন সে চাকুরীতে চলে যায়। চাকুরীতে গিয়েও জাফর ওকে ভুলতে পারেনি, ওর ঠিকানায় একটি চিঠিও লিখেছিল, “অন্তত: সারা জীবনের জন্য বন্ধু হয়ে থাকতে চাই”। কিন্তু ঐ চিঠির উত্তর পাওয়া যায় নি। সে চিঠিটা পেয়েছিলো কিনা তা জাফর আজো জানতে পারে নি! গোলক ধাঁধা জাফরের মনে রয়েই গেলো। ঐ দিকে ওদের কি অবস্থা তাও আর জাফর জানার চেষ্টা করে নি, আর করেই বা কি লাভ! তাছাড়া মেয়েটির ওপর জন্মেছিলো জাফরের প্রচন্ড অভিমান। তার শুধু মনে পড়ছিলো, বউয়ের জন্য স্বামীর আকুতি।

অবশেষে বলতে চাই জাফর ও মেয়েটির স্বামী দু’জনেই নিঃসন্দেহে ভালে মানুষ ছিলো। তবে একজন বউকে ফিরে পেলো, আরেকজন তার ভালবাসাকে চিরদিনের জন্য হারালো।

তাই কবির ভাষায় বলতে হয় “যেতে নাহি দিবো হায়, তবু চলে যেতে হয়, তবু যেতে দিতে হয়”।
এবার মন খারাপ হওয়ার মতো কথা শুনুন, বিশ বছর পর ঐ বেনজির বাগান বাড়ির মাস্তান বন্ধুটির সাথে চট্টগ্রামে জাফরের দেখা। বন্ধুটি বললো, জাফর ভাই আমাকে মাফ করে দিয়েন, আমি আপনার একটা অনেক বড় ক্ষতি করেছি! কথাটা শুনে অবাক হলো জাফর, কি এমন ক্ষতি!

বন্ধুটি বলতে লাগলো, যে দিন ৮/১০ জন আমরা আপনার বাসায় গিয়েছিলাম, ওটা ছিলো আমাদের পরিকল্পনা, মেয়েটি বিবাহিতা ছিলো না, ওর নাম ছিলো তিন্নি, ভালো মেয়ে, আপনাকে অনেক ভালোবাসতো। ওর বড় দুই বোন ছিলো অবিবাহিতা, তাই আপনাকে হাত বাঁধা বলে নিষেধ করতো। আর যে ভদ্রলোক আপনার হাত ধরে কেঁদেছিলো এটা ছিলো ওনার ছলনা। তিন্নির বাবা আমাদেরকে টাকা দিয়ে কাজটি করিয়েছিলো, তিন্নি তার কিছুই জানতো না! বন্ধুটি আরো বললো আপনিও অনেক বোকা ছিলেন, কারণ তিন্নির যদি চার বৎসরের মেয়ে থাকতো আপনি কি একবারও দেখতেন না? কথা শুনে বিশ বছর পর আবার মাথায় বজ্রপাত হলো।এতোবছর পর আর কি-ই বা করার থাকে বলুন??

লেখক- ইন্সপেক্টর (তদন্ত)

পরশুরাম মডেল থানা, ফেনী জেলা।

Comment here