রোহিঙ্গা সমাচার

আরাকানের থাবা বাংলাদেশে !

teknaf-pic-rohangya-26-11-2016 জাবেদ ইকবাল চৌধুরী :
এখনো আসছে রোহিঙ্গারা
সীমান্তে নিছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার পরও বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। তবে তা কয়েক সপ্তাহর চেয়ে তুলনামূলক ভাবে কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ঠরা। তবে এরপরও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রাতে এবং ভোরে কৌশলে দালালের সহায়তায় এখনো আসছে রোহিঙ্গারা। শনিবার ভোরে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসা মংডু পোঁয়াখালীর মোঃ কাশিম, সখিনা খাতুন, দুলাই বিবি, সহারু বেগমের সাথে কথা হয়েছে এ প্রবিবেদকের। তারা বলেন, বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ, শিশুদের ধরে আগুনে নিক্ষেপ, ধান ক্ষেত পুড়িয়ে ফেলা, যুবকদের ধরে নিয়ে যাওয়া, যুবতী নারীদের ধর্ষণের মত নারকীয় তান্ডব চালাচ্ছে মায়ানমারের সেনা বাহিনী। সেনা বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন থেকে বাচারঁ তাগিদে এবং খাদ্য সংকটের কারনে বাংলাদেশে আসা তাদের। পথে পথে এপার ওপার দুপারে দালালদের অর্থকড়ি দিয়ে পৌছতেঁ বেশ কষ্ট হয়েছে বলেও জানান। তারা বাংলাদেশে আসলে কিভাবে জীবন বাচাঁবে তা নিয়েও উৎকন্ঠায় রয়েছে বলে জানান। এ বিষয়ে মোঃ কাশিম জানান,‘ এখানে আমাদের জন্য কোন ব্যবস্থা হবে কি না জানি না।’ বাংলাদেশ সরকার বা বিশ্ব সম্প্রদায় বিষয়টি নিয়ে ভাবলেই রোহিঙ্গাদের রক্ষা এমনটিও মনে করেন তিনি।
৪ টি নৌকা বোঝায় রোহিঙ্গা ফেরত
শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত সীমান্তে বিজিবি ৪ টি রোহিঙ্গা বোঝাইdsc04237 নৌকা ঠৈকিয়ে দিয়েছে বিজিবি। এসব নৌকায় প্রায় ৬০ নারী শিশু ও পুরুষ রয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সুত্র। টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটলিয়ানের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল ছিদ্দিকী জানান, শুক্রবার রাত হতে শনিবার পর্যন্ত সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্টে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা কালে ৪ টি রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা আটক করা হয়। এসব নৌকায় থাকা রোঙ্গিাদের মানবিক সাহায্য হিসেবে খাবার ও পানীয় সরবরাহ করা হয়। পরে শনিবার রাতে স্ব স্ব পয়েন্ট দিয়ে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।  এক পশ্নের জবাবে বিজিবি কর্মকর্তা আবু রাসেল সিদ্দিকী জানান, এখন অনুপ্রবেশ প্রায় বন্ধ রয়েছে। সীমান্তে বিজিবির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কয়েকটি
পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টা থাকলেও বিজিবি’র সর্তক পাহারায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তবে ৯ অক্টোবরে মিয়ানমারের ৩ টি বিজিপি ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় ৯ বিজিপি সদস্য নিহত হয়। লুট হয় বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এর জের ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী মংডু জেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে তান্ডব শুরু করে। এরপর থেকে রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে । টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান ডাঃ দুদু মিয়া দৈনিক আজাদীকে বলেন, লেদা ক্যাম্পে ৬ টি ব্লক রয়েছে। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর উত্তরাঞ্চলের প্রায় ১৫ টি গ্রামে তান্ডব শুরু করে সেনাবাহিনী। বিশেষ করে গত ৯ নভেম্বর থেকে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। যার ফলে শত শত রোহিঙ্গা মুসলিম প্রাণবাচাঁতে বাংলাদেশে চলে আসতে থাকে। এ পর্যন্ত লেদা ক্যাম্পে এক হাজারের বেশী রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে বলেও জানান তিনি। উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক জানান, প্রথম দিকে অনুপ্রবেশের স্রোত ছিলো বেশী। কয়েক দিন ধরে পুলিশ-বিজিবির তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে অনুপ্রবেশও কমে গেছে। তিনি কুতুপালং ক্যাম্পে দেড় হাজারের মতো সাম্প্রতিক ঘটনায় আসা রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময়ে আসা পাচঁ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে এমনটি জানালেন কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী। তিনি জানান, শরনাথী হিসেবে টেকনফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং এ প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের দেখভাল বরছে ইউএনএইচসিআর। কিন্তু অন্য অনিবন্ধিত ক্যাম্প রয়েছে টেকনাফে লেদা, শামলাপুর , উখিয়ার কুতুপালং ও কক্সবাজারে সমিতি পাড়ায়। এসব ক্যাম্প ছাড়াও কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে প্রায় পাচঁ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। তাদের ভবিষ্যৎ কী তা কেউ জানে না । এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বোঝা হিসেবে রয়েছে।

সব হারালেন নূর বেগমdsc_0070
নুর বেগম (২৮)। মংডুর জাম্বনিয়া এলাকার বাসিন্দা। তাদের গ্রামে মায়ানমার সেনাবাহিনী হামলা চালাম ১৫ নভেম্বর। ওই দিন সকালে উপরে হেলিকপ্টারের লাঞ্চার নিক্ষেপ নিচে সেনা বাহিনীর আগুন তান্ডব। এ সময় সেনা বাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে স্বামী জামাল হোসেন পাশ্ববর্তী পাহাড়ে পালিয়ে যায়। অন্য দিকে মা নূর বেগম তিন সন্তানকে রক্ষায় পালানোর চেষ্ঠা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। সেনা বাহিনী ধরে আগুনে নিক্ষেপ করে দু সন্তান মোঃ হাসিম (৫) ও জাফর আলম (৩) কে। আগুনে পুড়ে মরলেও মা’র করার কিছুই ছিলো না। সাড়ে পাচঁ মাসের শিশু জানি আলমকে বুকে নিয়ে পালিয়ে বাচেঁ নূর বেগম। গ্রামের পাশ্বের্র ধান ক্ষেত ও পাহাড়ে কাঠায় বেশ কয়েক দিন। সে সময় তার দিন কাটে অর্ধাহারে অনাহারে। এ দশ দিনেও মেলেনি স্বামীর খোজঁখবর। পরে ঠিক করে বাংলাদেশ পালিয়ে জীবন বাচাবেঁ। কিন্তু কিভাবে সে পাড়ি জমাবে বাংলাদেশে। নেই ভাত , নেই টাকা। পরে অন্য এক রোহিঙ্গার সহায়তায় গত ২৫ নভেম্বর শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের কুমির খালী সীমান্ত ক্রস করে বাংলাদেশের তুমব্র দিয়ে প্রবেশ করে। শুক্রবার রাত সাড়ে ১০ টার সময় টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌছেঁ। সেখানেই এ বøকের জুলেখা বেগমের ঘরে আশ্রয় নেন । কিন্ত্র কয়েক দিনের অনাহারে অযত্বে অসুস্থ হয়ে পড়ে স্বামী সন্তান হারিয়ে একমাত্র বেচেঁ থাকা শিশু সন্তান জানি আলম। ২৬ নভেম্বর শনিবার সকালে মারা যায় অসুস্থ সেই শিশুটি। সব হারিয়ে এখন নির্বাক নূর বেগম। তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না ভাষা। আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করে বিলাপ কাদছেঁন। কেন তাকে পৃথিবীতে রেখে দেওয়া হলো। অন্যদের মতো তাকেও নিয়ে গেলেই সে যেন ধন্য হন। নিখোজঁ স্বামী ও তিন পুত্র শোকে কাতর নূর বেগম বলেন, মায়ানমারের সেনা বাহিনীর নির্যাতন, বাড়ী ঘর পুড়িয়ে দেওয়া ও শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করে সব শেষ করেছে তার পরিবারের। একমাত্র শিশু পুত্রটিকে নিয়ে বাচাঁর তাগিদে এখানে এসেছেন। এখন সেই শিশুটিকেও বার্চানো গেলো না। আর বেচেঁ থেকে লাভ কী এ আক্ষেপই করে অজোর নয়নে কাদঁিছলেন নূর বেগম।

আরাকানে থেমে নেই তান্ডব
রশিদ উল্লাহ (২৫)। আরাকানী যুবক। মংডু জেলার বড় গওজিবিলdsc_0055 গ্রামের মৃত বশির আহমদের ছেলে। ১৩ নভেম্বর দুপুরে তাদের গ্রামে হেলিকপ্টার থেকে হামলা চালানো হয়। এ হামলায় হতাহত হয় বেশ কয়েকজন নারী পুরুষ ও শিশু। তাদের একজন গুলিবিদ্ধ রশিদ উল্লাহ। তিনি জানান, ওই দিন হেলিকপ্টার থেকে ছোড়াঁ গুলির শব্দে প্রানভয়ে ছোট ভাই এনায়েত উল্লাহকে সাথে নিয়ে পালাতে থাকে। এক পর্যায়ে তার শরীরে বিদ্ধ হয় বেশ কয়েকটি গুলি। ঘাড়ে, কোমর ও পায়ে ৮/১০ টি গুলির আচর লাগে। এতে সে আহত হয়। দুই দিন পাহাড়ে কাতঁরাতে তাকে সে। পরে রাতের বেলায় পাহাড় হতে পাশ্ববর্তী রাইম্যাবিল গ্রামে আসে। ওই রাতেই এক দালালের মাধ্যমে জন প্রতি ১০ হাজার টাকা দিয়ে টেকনাফ সীমান্তের জাদি মোড়া এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দু ভাই। পরে লেদা ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে সে। আহত রশিদ উল্লাহ জানান, তাদের গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ীঘর জ্বলে গেছে। ওখানে থাকার পরিবেশ নেই। এখনো নিখোঁজ রয়েছে আপন বোন খুরশিদা বেগম। প্রাণ বাচাঁতে বাংলাদেশে চলে আসা। এখানে কী হবে তা তার অজানা। এ ভাবে এ অঞ্চলের ১৫ টি গ্রামে চলছে মায়ানমার সরকার বাহিনীর তান্ডব।
২৬ নভেম্বর শুক্রবার সকালে প্রাংপ্রং গ্রাম ঘিরে সেনা বাহিনী বেশ কয়েকজন যুবককে ধরে নিয়ে গেছে। মগনামা এলাকা প্রভাবশালী রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবার আব্দুল জলিল ও নুরুল ইসলামের বাড়ীতে হানা দিয়েছে। মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। সেনা বাহিনী আসার আগেই বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে লোকজন। এ সব তথ্য মোবাইল কথোপকথনের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা হাফেজ সোলতান মাহমুদ।

Comment here