এক্সক্লুসিভসারাদেশ

আয়নায় হায়েনার মুখ

আরিফা রহমান রুমা:কিছু কিছু যন্ত্রণা আছে যার তীব্রতা কখনোই কমেনা আবার এমন কিছু গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা থাকে যার দ্যুতি কোনদিনও এতোটুকু ম্লান হয় না, একাত্তর আমাদের জীবনে তেমনি এক মাহেন্দ্রকাল। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে জয়লাভ করেই বাঙালি জাতি পায় একটি স্বতন্ত্র ভূমি, পায় একটি আত্মপরিচয়, পায় লাল সবুজের রক্তস্নাত পতাকার অধিকার।

দিজাতিতত্ত্বের উদ্ভট ব্যাখ্যাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সবার জন্য সমান অধিকারের জন্য আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের। এ জয় ছিল পাকিস্তানি মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয়। এ জয় ছিল শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনতার জয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন এবং পরিকল্পনার সার্থক বাস্তবায়ন ঘটে তাঁরই নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তিতে। বিপুল সৈন্য নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান, এ দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজী ও বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের, লাল সবুজের পতাকা খুঁজে পায় তার সপ্নের আকাশ, পতপত করে উড়ে উড়ে জানান দেয় বিশ্বের বুকে তার গর্বিত উপস্থিতি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মানি ও জাপানের আত্মসমর্পণের ২৬ বছর পর এই প্রথম কোনো দেশের বাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলো সেদিন। দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে সশস্ত্র যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করা একমাত্র দেশ বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের কাছে তাই আত্মঅহঙ্কার, আত্মমর্যাদা আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।

এ জয়ের পেছনে চব্বিশ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস যেমন দেশেপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে তেমনিভাবে পাকিস্তানি শকুনদের সাথে একাত্ম হয়ে এই বাংলারই জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মনুষ্য আকৃতির আরও কিছু দানবরুপি পশু সৃষ্টি করেছিলো ইতিহাসের অন্যতম এক কলঙ্কিত অধ্যায়। রাজাকার বাহিনীর প্রধান মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী পরবর্তীতে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং আলশামস ও শান্তিকমিটির কুখ্যাত নেতৃতে শুরু করেছিলো নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ।

ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প নামক নরকে নারী যোগান দেয়া, মুক্তিযাদ্ধাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, বাড়িঘর লুটপাট থেকে শুরু করে এমন কোনো নিকৃষ্ট কাজ নেই যা তারা করেনি। তারা সবাই ছিল আসলে জামায়াত শিবির, মুসলিম লীগ এবং নেযাম ই ইসলামীর নেতা-কর্মী। এরা মূলত বাংলাদেশ চায়নি আর তাই হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালির আজন্ম লালিত সাধ তাঁর কাঙ্খিত স্বাধীনতা রুখতে। তাদের নারকীয় হত্যাকাণ্ডে প্রাণ দিয়েছে ত্রিশ লক্ষ মানুষ পাশাপাশি সম্ভ্রমহানি হয়েছে দুই লক্ষ মা বোনের।

ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণ কেবল ত্রিশ লক্ষ ব্যক্তি ছিলেন না, তাঁদের প্রত্যেকের একটি করে পরিবার ছিল, তাঁদের একে অপরের প্রতি হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা ছিল, নির্ভরতা ছিল যাকে হারিয়ে পরিবারটি হয়তো সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিল। পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে বেড়ে ওঠা সেসব শিশুর বদলে যাওয়া জীবনের পরতে পরতে ছিল পিছলে পড়ার মৃত্যুফাঁদ। সম্ভ্রম হারানো মা বোনের অনেককেই লজ্জায়, অপমানে বেছে নিতে হয়েছিলো আত্মহননের পথ। কথাগুলো পড়তে বা শুনতে কারো কারো কাছে আজ শব্দে শব্দে বাক্যের খেলা মনে হলেও নিজেকে এই শহীদ বা বীরাঙ্গনার জায়গায় বসিয়ে একবার দেখে নেইতো নিজের প্রিয় চারপাশ।

প্রিয় পাঠক তাহলেই দেখবেন শব্দ আর বাক্যের খেলা ভেঙে যেয়ে সেখানে কেবলি ভায়োলিনের করুন সুরে বেজে ওঠে এক একটি বিয়োগ গাথা, সেখানে কেবলি ঝরে পড়ার শব্দ, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার, বেঁচে থাকার মিছিলে দৌড়ে শামিল হবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। কেবল এখানেই থেমে থাকা নয় পরাজয় নিশ্চিত জেনে দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা শুধু তাঁদের পরিবারকে নয় স্বাধীন হতে যাওয়া বাংলাদেশকেই যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া।

জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আজ হিসাব নিকেশের পালা শুরু হলেও আমরা যেন আত্মতৃপ্তি আর সন্তুষ্টির ঢেঁকুর তুলে দিবানিদ্রা না যাই। আজ বিজয় আনন্দের ৪৫ বছর হলেও স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে সে সব ভুলে না যাই। আয়নায় আজও দেখা যায় সেই হায়নার মুখ। বিজয় মিছিলের সেই আনন্দ সমাবেশে আজ যখন সেই যুদ্ধাপরাধীদের দোসরদের দেখি অজানা আশঙ্কায় সত্যি শঙ্কিত হয়ে পড়ে মন। অতীত অভিজ্ঞতার আলোয় সাপের উদ্যত ফণার ছবিই ভেসে ওঠে যেন। বাধ্য হয়ে মেনে নেয়া যে দেশের অস্তিত্বই যারা হৃদয়ে ধারণ করে না, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে দেশের বাতাসকে দূষিত করতে যারা বদ্ধ পরিকর অতীত ভুলে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার ইঙ্গিত আর যাই হোক কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না- এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

Comment here