অন্যান্য

ওসি প্রদীপের দাপট দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতো রোহিঙ্গা সিন্ডিকেট! বন্দুক যুদ্ধে নিহত মা-বাবা : এতিম চার রোহিঙ্গ শিশুর কান্না থামাবে কে ?

মো: দেলোয়ার হোসেন , টেকনাফ :
রোহিঙ্গা শিবিরেও সক্রিয় ছিলো ওসি প্রদীপ কুমার দাসের সহযোগি চক্র। বিশেষ করে টেকনাফের লেদা নিবন্ধিত বস্তিতে পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতো চক্রটি। দাবী অনুযায়ি অর্থ না পেলেই সন্ত্রাসী, ডাকাত ইত্যাদি উপাধি দিয়ে মোবাইল ফোনে থানায় নালিশ দিয়ে হয়ারানি করতো । হাতিয়ে নিতো অর্থ।
এ চক্রটি স্বঘোষিত ভাবে ক্যাম্পের চেয়ারম্যান-মেম্বার তৈরী করে গড়ে তুলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সাথে সখ্যতা। শুধু তাই নয়, এরা ক্যাম্পে কর্মরর্ত সরকারী-বেসরকারী প্রতিধিনিদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সহযোগিতার নাম করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের চালাতো অত্যাচার-নির্যাতন। ক্যাম্পে নিজস্ব অফিস তৈরী করে নিয়মিত বসে বিচারের আসর। তাদের বিচার শালিস কেউ অমান্য করলেই নেমে আসে অত্যাচারের ষ্টীমরোলার। চেয়ারম্যান মো: আলমের অফিসে মওজুদ রয়েছে একাধিক লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে পেঠানো হয় বিচার অমান্যকারীদের। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হত। সাথে জুড়িয়ে দেয়া হত ভাংগা অস্ত্র বা মাদক। এভাবেই চলতো লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুলিশ কমিটি ও ব্লক মেম্বার-চেয়ারম্যানের শাসন।
এ শাসন থেকে রেহায় পায়নি রোহিঙ্গা দম্পতি দিল মোহাম¥দ ও জাহেদার পরিবার। রোহিঙ্গা ডাকাতদের খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ জড়িত এমন অভিযোগে গত ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকে লেদা হতে ধরে এ চক্রটি পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
অল্প সময় পরে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনায় তারা নিহত হয় বলে জানানো হয় । এ সময় আটককৃতদের সাথে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে বন্দুর যুদ্ধোর ঘটনা ঘটে বলে দাবী করে পুলিশ। এ সময় দুটি এলজি, একটি থ্্ির-কোয়াটার অস্ত্র , আট রাউন্ড গুলি ও বার রাউন্ড কার্তুজের খোসা উদ্ধার দেখায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লেদা ই ব্লকের সাবেক মাঝি মো: শফিকে ১০ সেপ্টেম্বর বিকেলে শত শত লোকের সামনে হতে আটক করে পুলিশ। দেখানো হয় ক্রসফায়ারের ভয়। এ সময় চক্রটি টেকনাফ মডেল থানা ওসি প্রদীপ কুমার দাসের কথা বলে মো: শফির স্ত্রী মোসলেমা হতে ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। পরে ২৩ অক্টোবর টেকনাফ নয়া পাড়া মুচনী এলাকায় রাস্তার উপর ডাকাতির প্রস্ততি কালে অস্ত্রস আটক দেখিয়ে অপর একজনের সাথে আদালতে চালান দেওয়া হয়। প্রায় দেড় মাস সময় ধরে থানার একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়ে ছিলো অভিযোগ করে মো: শফির স্ত্রী মোসলেমা খাতুন বলেন, “ ওসি প্রদীপের ঘনিষ্ট সোর্স পরিচিত আমির হোসেনের সহযোগিতায় দিনের বেলায় আমার স¦ামী মো: শফি (৫৫) কে লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দোকান হতে উঠিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর আমির হোসেন বিভিন্ন ভাবে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। টাকা ছিলো না। এ ফাকেঁ আমার বোন ও বোনের স্বামীকে অস্ত্র ঢুকিয়ে দিয়ে বন্দুক যুদ্ধ দেখিয়ে মেরে ফেলে। বর্তমানের তাদের চার এতিম সন্তান ভিক্ষা করে জীবন পাড় করছে। বন্দুক যুদ্ধের এ ঘটনায় আরো ভয় পেয়ে যায় আমি।
অনেক কষ্টে ৮০ হাজার টাকা জোগাড় করে আমির হোসেনের হাতে দিই। তারপর প্রায় ৪২ দিন অতিবাহিত করে অস্ত্র ও গুলি দিয়ে আমার স্বামীকে ডাকাত বানিয়ে চালান করা হয়। এভাবে আরো শত শত পরিবারকে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে এ চক্রটি। ”
অনুসন্ধানে উঠে আসে , মো: শফি আটক থাকা অবন্থায় চক্রটি মো: শফির শালিকা জাহেদা বেগম ও তার স্বামী দিল মোহাম্মদকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বন্দুক যুদ্ধের নামে হত্যা করে এমন দাবী ভুক্তভোগী পরিবারের। শুধু তাই বন্দুর যুদ্ধে নিহত জাহেদা তখন ছিলো ৮ মাসের অর্ন্তসত্বা । বর্তমানে তাদের পরিবারের চার শিশু এতিম। এ দম্পতির চার সন্তান মো: জুবাইর (১০), জুবাইরা বেগম (৭ ) , জান্নাত আরা (৬) ও সুফাইরা বেগম (৫) পিতা-মাতা হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে ।
অপরদিকে লেদা এফ ব্লকের রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক মো: ইয়াসিনকে গেলো ১৩ মে সকাল ৯ টার সময় ঘরে ঢুকে হাত-পা কেটে দিয়ে নির্মম ভাবে আহত করে লেদা কমিউনিটি পুলিশিং সভাপতি মোহাম্মদের নেতৃত্বে তার ভাই জমিল , ছেলে খোকন , শালক হারেস (রোহিঙ্গা ) , রোহিঙ্গা মেম্বার মো: আলম , মোহাম¥দ শাহ , সন্ত্রাসী জাবের ও আরএসও নেতা আমির হোসেন। সে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পে মাদক পাচার প্রতিরোধে ভুমিকা রেখেছিলো। চক্রটি তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের ব্যবসা নির্বিঘœ করতে এমনটি ঘটিয়েছে বলে দাবী অন্যান্য সাধারণ রেহিঙ্গাদের।
এ ঘটনায় কয়েক মাস ধরে টেকনাফ মডেল থানায় মামলা করতে আসলেও কেউ আমলে নিচ্ছে না তার অভিযোগ। ভুক্তভোগী রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক মো: ইয়াসিন বলেন , “ স্থানীয় কয়েকজন গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের নাম ভাঙ্গিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালাতো আমির হোসেন, মো: আলম , মোহাম্মদ শাহ চক্রটি। এদের অত্যাচেরের বিষয়ে থানায় অভিযোগ নেওয়া হতো না। নির্মমভাবে আমার হাত পা কেটে ফেলা হলো। ্এরপরও মামলা হলো না থানায়। ” তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা এক নারীকে বিয়ে করে লেদা বস্তিতে অবস্থান করে ্আলীখালী গ্রামের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সভাপতি পরিচয়ধারী মোহাম্মদ ও তার সহযোগি লেদা এলাকার খালেক ক্যাম্পের চক্রটির সাথে হাত করে রামরাজ্য কায়েক করেছে। ”
এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার বিষয় রহস্যজনক ভাবে আমলে নেয়নি টেকনাফ মডেল থানার পুলিশ। লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে জানা যায়, মাদক সম্পৃক্ততার দায় স্বীকার করে আত্বসর্¤úণকারী হ্নীলা ইউনিয়নের স্থানীয় মেম্বার নুরুল হুদা গ্রুপের সহযোগী ও আলীখালী গ্রামের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সভাপতি মো: মিয়ার সহায়তায় লেদা রোহিঙ্গা বস্তির (এলএমএস ) চেয়ারম্যান মো: আলম (এফ ব্লক), মোহাম্মদ শাহ মেম্বার (ই ব্লক) বাইলা মাঝির ( সি ব্লক ) সমন্বয়ে চক্রটি টেকনাফ মডেল থানায় বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাসের নামে ব্যাপক চাদাঁবাজি-অপকর্ম করেছে। প্রতিপক্ষকে বিভিন্ন মামলায় ফাসিঁয়ে হয়রানি করে যাচ্ছে। এতে কৌশলে সমন্বয়কারীর ভ’মিকা পালন করছে ক্যাম্পের সাবেক সেক্রেটারী ও আরএসও নেতা আমির হোসেন। এলাকাবাসীরা জানান, আমির হোসেন এক সময় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ‘ রোহিঙ্গা সলিডারেটি অর্গানাইজেশন ( আরএসও) কমান্ডার হিসেবে সশস্ত্র অবস্থায় দায়িত্ব পালন করেন। পরে পাকিস্থান , আফগান ও সৌদিয়া ঘুরে জঙ্গি প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশ এসে লেদায় আশ্রয় নেন। শুধু তাই নয় এই আরএসও নেতা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় পত্র ও ঝিমংখালী এলাকায় জমি ক্রয় করেও ঘর বাড়ি তৈরী করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর চেয়ারম্যান মো: আলম টেকনাফের শামলাপুর এলাকা হতে বেশ কয়েক বছর ধরে সাগর পথে মানব পাচার করে অঢেল অর্থেও মালিক হন। পরে কৌশলে পুলিশের ছত্রছায়ায় লেদা এলাকার স্বঘোষিত চেয়ারম্যান বনে গিয়ে তান্ডব চালাতে থাকে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আশা করছেন সাধারন রোহিঙ্গা পরিবার গুলো।

নাম প্রকাশে অনিইচ্ছুক এক রোহিঙ্গা বলেন, “ মাদক বিরোধী অভিযানের সুযোগ কাজে লাগিয়েছে চক্রটি। এতদিন তাই ক্রসফায়ার , মিথ্যা মামলা ও নির্যাতনের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। এখন টেকনাফ থানার সেই ওসি কারাগারে আটক থাকায় নির্যাতিতরা মুখ খোলার সাহস পেয়েছে। সেই দাপট দেখানো রোহিঙ্গা নেতারাও চুপছে গেছে। ” ওসি প্রদীপের নামে চাদাঁ আদায়কারী এ চক্রের সদস্যদের আটক করলে অনেক অপকর্মেও তথ্য বের হয়ে আসবে বলেও দাবী করেন তিনি।

Comment here