আন্তর্জাতিকরোহিঙ্গা সমাচার

কক্সবাজারে বিজিবি- বিজিপি পতাকা বৈঠক ২৩ নভেম্বর : সীমান্তে নাজুক পরিস্থিতি : ঠেকানো যাচ্ছে না অনুপ্রবেশ

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী:teknaf-rohamg-pic teknaf-pic-21-11-2016
পাঁচটি ইস্যু নিয়ে কক্সবাজারে বৈঠক বসছে বিজিবি ও বিজিপি কর্মকর্তারা। ২৩ নভেম্বর সকালে কক্সবাজার শহরের একটি হোটেলের সম্মেলন কক্ষে এ সভাটি হওয়ার কথা রয়েছে। এতে মিয়ানমারের পক্ষে ২৫ সদস্যের প্রতিনিধি টিমের নেতৃত্ব দেবেন ১ নং বিজিপি’র কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মি.থেয়া থেনলুইন । আর বাংলাদেশের পক্ষে সম সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে উক্ত বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন বিজিবি ইর্ষ্টান জোনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফরিদ হাসান। তবে পাচঁটি ইস্যু কি হবে তা সংশ্লিষ্টারা স্পষ্ট না করলেও এখানে সামপ্রতিক ঘটনা, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, ইয়াবাসহ মাদক ও নাফনদী হতে বাংলাদেশী জেলে অপহরনের মত বিষয় যে আলোচিত হবে তা নিশ্চিত ।
তবে এখানে দিন দিন সীমান্ত পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ঊঠেছে। দিনের বেলায় অনুপ্রবেশের ঘটনা দেখা না গেলেও গভীর রাতে ঠেকানে যাচ্ছে না মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মংডু শহরের উত্তাঞ্চলেরর রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম গুলোতে রাখাইন সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনীর সম্মিলিত অত্যাচার নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। এরফলে শত শত রোহিঙ্গা নারী পুরুষ শিশু সন্তানদের নিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে, বনাঞ্চল ও ধানক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছে। দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকলেও রাতের সময় নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ-কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। সীমান্তে বিজিবি-কোস্টগার্ড সদস্যরা দিবারাত্রী টহল জোরদার রাখলেও ফাকঁফোকর দিয়ে ঠিকই ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। এদের মধ্যে কেউ কেউ নির্যাতনের শিকার হলেও বেশীর ভাগ গ্রাণভয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এর ফলে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সীমান্ত পরিস্থিতি জঠিল আকার ধারন করছে। বিশেষ করে বিদেশী গনমাধ্যম , ফেসবুকসহ বিভিন্ন মোবাইলে সেখানকার নির্যাতনের ভিডিও ও ছবি প্রকাশ পাওয়ায় বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছে সীমান্ত পাড়ের লোকজন। টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তের দু’টি ক্যাম্পে প্রায় ৩৫ হাজারেরও অধিক শরনার্থীর পাশাপাশি অনিবন্ধিত প্রায় কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম অবস্থান করছে কক্সবাজার -বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায়। এ সব রোহিঙ্গাদের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত ৯ অক্টোবরে মিয়ানমারের বিজিপি ক্যাম্পে হামলায় ৯ বিজিপি সদস্য নিহত ও অস্ত্র গোলাবারুদ লুটের পর শুরু হয় আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতন। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান বলে মিয়ানমার সরকার পরিচালিত এ কর্মকান্ড রোহিঙ্গা মুসলিম খতমের অভিযান বলে দাবী করেছে রোঙ্গিারা। ইতিমধ্যে ৬৯ জন রোহিঙ্গাকে হত্যার কথা স্বীকার করলেও সেখানে দু’শতাধিক নারী পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলে একটি সুত্র নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া বাড়ী ঘর ,মসজিদ ও দোকান জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে শত শত। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। কাজ না পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের আয় রোজগার বন্ধ রয়েছে। ফলে বাচাঁর তাগিদে দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে এমনটি জানালেন গত ২০ নভেম্বর রবিবার ভোরে টেকনাফে অনুপ্রবেশ করা মোঃ আলম। তিনি জানান, মংডু খেয়ারী প্রাং এলাকায় নিজ বাড়ীর সামনে তা ছিলো মুদি দোকান। ৮ সন্তান নিয়ে ১০ সদস্যের তাদের পরিবারে অভাব ছিলো না। ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র রবি আলম,প্রথম শ্রেণির ছাত্র মোঃ রফিক ও প্রাক প্রথম শ্রেনির ছাত্র মোঃ হারেসসহ সবাইকে সাথে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এখন কি হাল হবে সে জানে না। স্কুল পড়–য়া ছেলেদের কি হবে তা ভেবে সে অস্থির । কিন্তু উপায় ছিলো তার। ৮ জন ছেলে মেয়ে নিয়ে কি ভাবে চলবে তার সংসার। দোকানটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর কাজ করারও সুযোগ নেই। মুসলিম দেশ একটু হয়তো সহানুভুতি পাবে সে আশায় বাংলাদেশ আসা তার। কিন্তু আজকে সে এক টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। কাল তার কি হবে এ নিয়ে চিন্তিত মোঃ আলম।
একই কারনে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে এক সন্তানের জননী রশিদা বেগম। ২০ নভেম্বর রবিবার ভোরে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং মিনাবাজার সীমান্ত দিয়ে সে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। স্বামীকে রেখে সে সম্ব্রম বাচাঁতে পালিয়ে আসে। এক ১০ দিন লেগেছে মিয়ানমারের নিজ গ্রাম পোয়াখালী চাককাটা পাড়া থেকে টেকনাফ পৌঁছতে তার। সাথে ছিলো শ্বাশুড়ি বাহারু বেগমসহ অন্য ১০ জন। রাতের বেলায় পাহাড়ী পথ ও ধান ক্ষেত মাড়িয়ে রাত্রে নাফ নদী ক্রস করেছে এরা। পথে পথে কয়েকটি জায়গায় টাকা দিয়ে সে এটুদূর পৌছঁতে পেরেছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯ নভেম্বর শনিবার দুপুরে শুনতে পেয়েছে তার স্বামী মোঃ সলিমকে মিয়ানমার রাখাইন সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। রশিদা স্বামীর চিন্তায় আবেগ তারিত হয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, মিয়ানমারে গুলোযোগ শুরু হরয়ার পর অনেক দরিদ্র মুসলিম পরিবারকে ১৫ কেজি করে চাল বিতরন করেছে। ধানচাষ করে প্রচুর ধান বাড়িতে জমিয়ে রাখা ছিলো, বাড়ীর আঙ্গিানায় বাধা ছিলো হালের গরু মহিষ, সক কিছু ফেলে শুধু মাত্র ইজ্জত আব্রæ রক্ষার জন্য এখানে আসতে হয়েছে। তার স্বামীর কোন দোষ ছিলো না। কাউকে কোন দিন অন্যান করেনি। শুধু সাহায্য করেছে এলাকায়। আর আজ তা কি হাল তাকে মেরে ফেলা হবে। খবর পাওয়া গেছে চোখ বেধে, মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে যে ফেরত আসবে সে আশা করা যায় না। কেন আমাকে এখানে আসতে হলো একটি সন্তান নিয়ে। ছিলাম জমিদার , আমরা গরীব মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছি। আজ হয়তো আমাকে হাত পেতে ভিক্ষা করে চলতে হবে। এভাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না তাদের রক্ষায়।

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা বস্তির চেয়ারম্যান ডা.দুধু মিয়া জানান, দু’ এক দিনের মধ্যে রাতের সময় বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবার এ ক্যাস্পে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের তাৎক্ষনিক অবহিত করেছেন বলেও দাবী করেন। তিনি আরো জানান, মিয়ানমার থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কারো জন্য সুখকর নয়। মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালী বলে অবহিত করে থাকে। সেখানে মুসলিম শুণ্য করে রাখাইন পল্লী গড়ে তুলতে এটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে মিয়ানমার। তিনি সীমান্ সুরক্ষিত করে অনুপ্রবেশ বন্ধ করার ও আহবান জানিয়েছেন কিজিবি ও কোষ্টগার্ডের প্রতি।
এদিকে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকলেও স্বীকার করছে না সংশ্লিষ্টরা। বিজিবি ও কোস্টগার্ড কর্মকর্তারা বলছে সীমান্ত স্বাভাবিক রয়েছে। টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটলিয়ান কমান্ডার লে.কর্ণেল আবু জার আল জাহিদ বলছে, সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্যরা রাতের সময়ও নাফনদীতে টহল জোরদার করেছে। ফাকঁ ফোকরদিয়ে হয়তো দু এক পরিবার ঢুকে যাওয়া অসম্ভব নয়। তবে ঘটনার বয়াবহতা সে ভাবে প্রচার হয়েছে সে অনুপাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এখনো নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে সর্তক রয়েছেন বলেও জানান।
এ ছাড়া টেকনাফ উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ সফিউল আলম ও মডেল থানার ওসি মোঃ আব্দুল মজিদ ২১নভেম্বর সোমবার সকাল থেকে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা বস্তি, নয়া পাড়া শরনার্থী ক্যাম্প ও বৌদ্ধ বিহার গুলো পরিদর্শন করেছেন। যাতে সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা কলেছেন। ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্পীতি রক্ষায় সভা ডাকার জন্য নিদের্শনা দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিটি বৌদ্ধ বিহার পাহারা দেওয়ার জন্য ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করার কথাও জানালেন ইউএনও।
এর আগে সীমান্তে যাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ যাতে ঠেকানো যায় সে বিষয়ে বেশ কয়েকদিন আগে বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে সচেতনতা মূলক সভা করেছে বিজিবি। এর বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি মোঃ আব্দুল মজিদ জানান, টেকনাফ সীমান্তের কাছাকাছি মংডু এলাকায় মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাতকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যাতে কোন গোষ্ঠি অপতৎপরতা চালাতে না পারে সে ব্যাপারে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। তাই বিভিন্ন স্থাপনা ও গ্রাম পরিদর্শন করে সেই মেসেজটুকু জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

Comment here