অন্যান্যক্রাইমরোহিঙ্গা সমাচার

ক্যাম্পের একক আধিপত্যে জকির ডাকাত : শালবাগান-লেদায় আতংকে সাধারণ রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা

বিশেষ প্রতিবেদক :
রোহিঙ্গা-স্থানীয়দের সমন্বয়ে সংগঠিত স্বশস্ত্র সিন্ডিকেট অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এরা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় অপহরণ, হত্যা, চুরি, ডাকাতি থেকে শুরু করে করছে না এমন অপর্কম বাকী রাখেনি। দিনের বেলায় কেউ কেউ ভালো মানুষ সাজঁলেও রাতের সময় এরা স্বশস্ত্র। ফলে এদের অনেককেই চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এসব সিন্ডিকেট স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের সমন্বয়ে গঠিত । এতে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়না। স্থানীয়দের বাড়ী ঘরে অপর্কম ঘটলে দোষ রোহিঙ্গাদের চাপিয়ে দেওয়া সহজ। আবার রোহিঙ্গাদের উপর কিছু হলে স্থানীয়দের দায়ী করে সহজে পার পাওয়ার চেষ্টা চালায় এরা। এ ধরনের একটি সিন্ডিকেটের খবর পাওয়া গেছে টেকনাফের শালবাগান, নয়াপাড়া লেদা কেন্দ্রিক রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায়।
রোহিঙ্গা ডাকাত জকিরের নেতৃত্বে স্থানীয় লেদা নূর আলী পাড়ার মুহাম্মদ হাসান, মুক্তার হোছন, রবিউল আলম, মোহাম্মদ নূর, শরিফ হোসেন, আব্দুল গফুর, ছৈয়দ নূরসহ একটি শক্তিশালী সশস্ত্র গ্রæপ সক্রিয় রয়েছে। অপর দিকে জাদিমোড়া ২৭ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেড মাঝি সৈয়দ হোসেনও সক্রিয় রয়েছে এমন অপতৎপরতার সাথে। খোদ ক্যাম্পের সাধারন রোহিঙ্গারা উক্ত হেড মাঝির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন প্রতিকার দাবী করে। গেল বছর ৩০ নভেম্বর বিকেলে লেদা নুর আলী পাগা হতে নুরুল আলমের ছেলে মো: সাহাব উদ্দিনকে অস্ত্রসহ আটক করে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইসি এসআই মো:বাবুল। আটক সাহাব উদ্দিন রোহিঙ্গা ডাকাত জকির গ্রæপের সক্রিয় সদস্য বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এ গ্রæপের সদস্যরা গত বছর ১৯ জানুয়ারি ও ৩০ নভেম্বর দু’দফায় ইমান হোসেনকে ও মিজবাহ উল জান্নাত নামের দু’জন কে মারধর করে টাকা ও স্বর্নালংকার হাতিয়ে নেয়। এ গ্রæপের সদস্যরা সম্প্রতি র‌্যাবের ২ জন সদস্যকে গুলিবিদ্ধ করে আহতও করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ছাড়া মাদক, হত্যা , অপহরন, ডাকাতিসহ একাধিক মামলা রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। এ গ্রæপের অত্যাচারে ইতিমধ্যে লেদা নুর আলী পাড়া হতে ৮০ টি রোহিঙ্গা পরিবার পালিয়ে গেছে অন্যত্র এমনটি জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তবে এই এলাকার ক্যাম্প ইনচার্জ আব্দুল হান্নান (উপ-সচিব) জানিয়েছেন, ডাকাতের ভয়ে প্রায় ২০ টি রোহিঙ্গা পরিবার পালিয়ে এসছিলো। তবে পরে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলায় তারা ফিরে যায়। এখন সেখানে নিরাপত্তা জোরদার রয়েছে বলেও জানান তিনি।
শালবাগান ও লেদার একক আধিপত্যে জকির গ্রæপ : আরসা সামরিক প্রধান হাফেজ আতাউল্লাহ’র ডান হাত হিসেবে পরিচিত নুর আলম অবস্থান করতেন টেকনাফের নয়াপাড়া শরনার্থী ক্যাম্পে। নয়া পাড়াতে দু’স্ত্রী ও লেদা অনিবন্ধিত ক্যাম্পে অপর স্ত্রী অবস্থান করায় নুর আলম দু’ ক্যম্পে সমান আধিপত্য রাখতেন। এ ছাড়া আরসা প্রধান হাফেজ আতাউল্লাহ’র সাথে ভিডিও তে নুর আলমকে ভারী অস্ত্র হাতে ডান পার্শ্বে দেখা যাওয়ায় তাকে সবাই সমিহ করে চলতো। এ ছাড়া র‌্যাব-৭ এর হাতে আটক হয়ে নয়া পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লুন্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার, পরে জামিনে মুক্ত হওয়ায় তার শক্ত অবস্থান তৈরী হয়েছে আরসা ও রোহিঙ্গাাদের মাঝে। ২০/২৫ জনের এ প্রæপের অপর কয়েকজন উপ-প্রধান ছিলেন জাদিমুড়ার নুর মোহাম্মদ, মুছনী নয়াপাড়ার লম্বা সেলিম, মাষ্টার আবুল কালাম আজাদ, খাইয়ুর আমিন। এ প্রæপটি ২০১৬ সালের ১৩ মে ভোররাতে নয়াপাড়া শালবন আনসার ব্যারকে হামলা চালায়। খুন করে আনসার কমান্ডার আলী হোসেন কে। লুট করে নিয়ে যায়, ২টি এসএমজি, ৫ টি চায়না রাইফেল, ৪ টে শর্টগান ও ৬৭০ টি গুলি। পরে অবশ্য অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার কওে র‌্যাব-৭। এ গ্রæপের অন্যান্য সদস্যরা হচ্ছে নুরুল আলম, হাসেম, হাসান, জামাল, রুবেল, মাহামুদুল হাসান ও শুক্কুর। এ প্রæপের প্রধান নুর আলম গত জানূযারী মাসের প্রথম দিকে জেল হতে বের হয়। পুনরায় সংগঠিত হয়ে লেদা ও নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পশ্চিমে আলীখালী পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে অপর্কম চালায়। গত বছর আলোচিত সেই নুরুল আলম বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়। এখন তার সেকেন্ড ইন কমান্ড লম্বা সলিম দায়িত্ব পাণ করছেন। লম্বা সেলিমের সাথে সখ্য গড়ে তোলে আরেক রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদ।
গত বছর ২২ আগষ্ট বৃহস্পতিবার রাতে লম্বা সলিমের নেতৃত্বে একদল রোহিঙ্গা স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী টেকনাফের লেদা ওযার্ড যুবলীগ সভাপতি উমর ফারুককে হত্যা করে। এদের হাতে ভারী অন্ত্রসহ বিদেশী পিস্তল রয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। পরে বন্দুক যুদ্ধে নুর মোহাম্মদ নিহত হয়। লম্বা সেলিমও লাপাত্তা হয়ে যায়।
এখন লেদা , শালবাগান নয়া পাড়া ভিত্তিক জহির গ্রæপ সক্রিয় রয়েছে। সেখানে তার একক আধিপত্য চলছে। সে স্থানীয়দের সাথে হাত মিলিয়ে গ্রামীন ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সমান তালে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয়রা আইনশৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এতে উল্লেখ করা হয়েছে , লেদা নূর আলী পাড়ার মুহাম্মদ হাসান, মুক্তার হোছন, রবিউল আলম, মোহাম্মদ নূর, শরিফ হোসেন, আব্দুল গফুর, ছৈয়দ নূর এবং জাদিমোড়া ২৭ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেড মাঝি সৈয়দ হোসেনসহ বেশ কয়েক জন সন্ত্রাসী কাজে ডাকাত জকিরের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে।
এদিকে টেকনাফের লেদা কেন্দ্রিক আরো বেশ কয়েকটি গ্রæপ কাজ করছে। এরমধ্যে রফিক গ্রæপের সাথে রয়েছে রহিমুল্লাহ, রফিক, শফিউল্লাহ। ছাদেক গ্রæপের সাথে রয়েছে কাসেম, সেলিম। দক্ষিন লেদায় রয়েছে বেলাল গ্রæপের অবস্থান। এ প্রæপের অপর সদস্যরা হচ্ছে , রাসেল, সোনা মিয়া, হেলাল, নুরুল ইসলাম, জয়নাল, কামাল, জামাল হোসেন।
এখনো অধরা হাকিম গ্রæপ : এ ধরনের গ্রæপ গুলোর মধ্যে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের পশ্চিমের পাহাড়ে ৩০/৪০ জনের নেতৃত্বে রয়েছে দূর্ধষ ডাকাত সর্দার আব্দুল হাকিম। মিয়ানমারের মংডু বড় ছড়া এলাকার জানে আলমের ছেলে হাকিম। সে নিজেকে আল-অ্যাকিন-২ এর প্রধান বলেও ঘোষনা দিয়েছে। এ গ্রপটির মধ্যে বিদেশি পিস্তল, ভারী অস্ত্র, দেশিয় কাটা রাইফেল, ওয়াকিটকি জাতয়ি প্রযুক্তি রয়েছে। এ গ্রæপটির মধ্যে টেকনাফের শামলাপুর, উখিয়ার কুতুপালং, বালূখালী, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, মিয়ানমার পর্যন্ত শক্ত অবস্থান রয়েছে। তাদের হাতে স্থানীয় আওয়ামীলীগ ইউনিয়ন সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলামসহ ১৫/২০ জন মানুষ খুন হয়েছে। আব্দুল হাকিমের ভাই নজির আহমদ, কবির আহমদসহ বেশ কজন সহযোগি ইতিমধ্যে বন্দুক যুদ্ধে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে । এ প্রæপের অন্যান্য সদস্যরা হচ্ছে , কালাবদা মাঝি, কুতুপালং ডি-৩ ’র ঢালু মাঝি, ই-৩’র কামাল মাঝি, নয়া পাড়া ক্যাম্পের রশিদুল্লাহ, হারুন ও রফিক, লেদা অনিবন্ধিত ক্যাম্পের কালু ও শফিউল্লাহ।
দিনে এনজিও রাতে সশস্ত্রদের দখলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প!
বাংলাদেশে গড়ে উঠা রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ গুলো বেশির ভাগই ইয়াবা পাচারে জড়িত । নদী বা পাহাড়ি পথ হতে মিয়ানমার হতে আনা ইয়াবা গুলো এরা পাহাড়ে তাদের আস্তানায় নিয়ে নিরাপদে যথাযথ পাচারকারীর কাছে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছে এমন খবর পাওয়া গেছে এলাকার সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। নাম প্রকাশে অনিইচ্ছুক সাধারণ রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, পাহাড়ে গড়ে উঠা এসব অস্ত্রধারি রোহিঙ্গারা কমিশন ভিত্তিতে ইয়াবা পাচারে জড়িত হয়ে লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েছে। এসব টাকায় কিনছে অস্ত্রও। এরা চুরি , ডাকাতি, চাদাঁবাজি, অপহরন, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক একাধিক এ ধরনের গ্রুপ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। কেউ এদের বিরোদ্ধে মুখ খোলার সাহস পায় না। এমনকি অনেক সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর খুব কাছাকাছি থাকলেও এদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশন দেখা যায় না। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে মুখ খোলার লোকজন গুলোও চুপসে যায়।
নতুন রোহিঙ্গা এবং ২০৯১ সালের পুরানো রোহিঙ্গারা একাকার হয়ে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক অপরাধ, অস্ত্র ,মাদক পাচার, ও জঙ্গি তৎপরতার শংকা দেখা দিয়েছে। সশস্ত্র গ্রæপ গুলোর তৎপরতা আশংকা জনক ভাবে বৃদ্ধি পয়েছে। এ সমস্ত ক্যাম্পে আইন শৃংখলা বাহিনীর অবস্থান, নজরদারী প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে তাদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। এদের তৎপরতায় প্রত্যাবাসন তৎপরতাও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বিষয়টি স্থানীয়দের জন্যতো বটেই আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাড়াতে পাড়ে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল। জানা গেছে রোহিঙ্গা কেন্দ্রিক এসব গ্রæপের সাথে স্থানীয়দের রয়েছে দহরম মহরম সম্পর্ক। এ সম্পর্কের জের ধরে যে কোন ধরনের রাস্ট্রবিরুধী কর্মতৎপরতা পরিচালনা অসম্ভব নয়।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন,
রোহিঙ্গা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ক্যাম্প গুলোতে দিনে এনজিও ও রাতে রোহিঙ্গারা নিয়ন্ত্রন করছে। স্থানীয়রা অসহায় হয়ে পড়েছে। তাই রোহিঙ্গাদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ রাখা জরুরী। বিশেষ করে পাহাড়ে এদের স্বশস্ত্র অবস্থান উদ্বেগজনক। ইতিমধ্যে আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের দুজন স্থানীয় নেতাকে খুন করেছে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসীরা। এদের আসল খুনীকে আটক করা সম্ভব হয়নি এখনো।
টেকনাফ মডেল থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওসি এবিএমএস দোহা জানিয়েছেন, ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতা অনেক কমে এসেছে। পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনী সেখানে অভিযান ও টহল বৃদ্ধি করেছে।

Comment here