জাতীয়রাজনীতি

ছয় সিটির ভোটে জিততে আগাম প্রস্তুতি আ. লীগে

পার্থ সারথি দাস
দেশের ছয়টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জিততে আগাম পরিকল্পনা এবং সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব মহানগরীতে দলের গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষায় নিশ্চিতভাবে উত্তীর্ণ হতে জোরালো প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি মেয়র পদে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজেও মনোযোগ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। ছয় সিটির মধ্যে রংপুর ছাড়া অন্য পাঁচটিতেই ২০১৩ সালের নির্বাচনে মেয়র পদে হেরে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীরা। সেই গ্লানি থেকে রেহাই পেতেও এবার আঁটঘাট বেঁধে নামছে আওয়ামী লীগ। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুসারে, রংপুরে ভোট হবে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর। বাকি পাঁচ সিটিতে ভোট হবে আগামী বছরের মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ছয় সিটির মধ্যে দুটিতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আগের বারের দুই প্রার্থীকে এরই মধ্যে সবুজ সংকেত দিয়েছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই মাঠে তত্পরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন ওই দুই নেতা। বাকি চারটিতে নতুন প্রার্থী খোঁজার ওপর জোর দিচ্ছেন দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা।

২০১৩ সালের ১৫ জুন একই দিনে নির্বাচন হয়েছিল রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের। একই বছর ৬ জুলাই ভোট হয়েছিল গাজীপুরে। ওই সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজয়ের একটি বড় কারণ ছিল দলীয় কোন্দল ও মনোমালিন্য। তবে একাধিক ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ঘটে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত।

আগের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এবার ওই পাঁচ সিটি করপোরেশনে সরকারের উন্নয়নচিত্র তুলে ধরে দলীয় প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। তবে তার আগে ওই সব স্থানে দলীয় কোন্দল মিটিয়ে ফেলতে ধারাবাহিক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী ও নেতাদের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। গত ৯ জুলাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় ওই নির্দেশ দেন তিনি। দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত ২১ জুলাই আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায়ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে। প্রস্তুতি আরো জোরদার করতে নির্দেশনা দিয়েছে দলের হাইকমান্ড। দলীয় সভাপতি যোগ্য প্রার্থী মনোনয়নের ওপর জোর দিচ্ছেন।

সূত্র মতে, বিভিন্ন স্থানে দলীয় কর্মসূচিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন নিয়মিত। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বৃহস্পতিবার বরিশালে এবং পরদিন পটুয়াখালীতে দলের সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন। বরিশালে কর্মসূচি উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর নাম বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল। বরিশাল আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, দলকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনমুখী করতে এরই মধ্যে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা গেছে। গত শনিবার গাজীপুরে এক জনসভায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল ওবায়দুল কাদেরের। বিশেষ কারণে ওই সভা হয়নি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ওই সভায় উপস্থিত রাখার পরিকল্পনা ছিল। খুলনা বিভাগীয় প্রতিনিধিসভা হয়েছে গত ৯ জুলাই। দলের সাধারণ সম্পাদক তাতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি খুলনা সিটি নির্বাচন সামনে রেখে এখন থেকেই কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীদের।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ‘দলের বিভিন্ন ফোরামে সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা গুরুত্ব পাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ, সাংগঠনিক প্রতিবেদন, অতীত পর্যালোচনা করে আমরা যোগ্য প্রার্থী চাইছি। সাংগঠনিক সফরেও আমরা বিষয়টি তুলে ধরছি। ’

আওয়ামী লীগের একাধিক সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ‘যোগ্য’ প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা এবং ভোট টানার সামর্থ্যের বিষয়টিকেই প্রধান বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। ওই নির্বাচনে প্রায় ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারের বড় কারণ ছিল দলীয় কোন্দল। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিষয়ে গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে কুমিল্লায় পরাজয়ের পর থেকেই। সেখানে দলের পক্ষে নির্বাচনী তত্পরতায় যুক্ত ছিলেন এমন একাধিক নেতা জানান, কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন্দলের জন্যই দলীয় প্রার্থী পরাজিত হন। ওই রকম কিছু হতে পারে তেমনটি আগে থেকে বুঝতেও পেরেছিলেন তাঁরা।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, দুই সিটিতে মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী হিসেবে আগের দুই প্রার্থীর ওপরই ভরসা রাখতে চাইছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা। ওই দুজনের একজন হলেন রাজশাহীর এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাবেক মেয়র। যদিও ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। তাঁকে পরাজিত করেছিলেন নতুন মুখ বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। লিটন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি। কেন্দ্র থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর গণসংযোগ করছি। ’

সূত্র মতে, সিলেটে দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে। গত ৯ জুলাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা থেকে ওই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে কামরান হেরেছিলেন বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে। ওই সময় পরাজয়ের বড় কারণ ছিল কামরানের ওপর সাধারণ ভোটারদের ক্ষোভ। দলীয় নেতাকর্মীদেরও একটি অংশ নিষ্ক্রিয় ছিল। কামরান সবুজ সংকেত পাওয়ার পর মনোনয়নপ্রত্যাশী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ এবং ব্যবসায়ী মাহিউদ্দিন আহমদ সেলিমের অনুসারীদের তত্পরতা কমে গেছে।

বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে ছয় সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আওয়ামী লীগের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এলাকায় জনগণের কাছে ছিলাম, এখনো আছি, কাজ করছি। দলীয় সভাপতির সিদ্ধান্তই আমার কাছে বড়। ’

অন্য চার সিটিতে বেশি তত্পর যাঁরা : রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও গাজীপুরে পুরনো প্রার্থীরা এবার দলীয় মনোনয়ন পাবেন কি না তা নিশ্চিত নয়। খুলনায় মেয়র পদে দলের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টায় তত্পর আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল। খুলনা সিটি করপোরেশনে গত নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেখানে গত সিটি নির্বাচনে তাঁর পরাজয়ের পেছনে ছিল দলীয় কোন্দল। তালুকদার আবদুল খালেক বলে আসছিলেন, তিনি নিজে মেয়র পদে দাঁড়াবেন না। তাঁর অনুসারিরা জানিয়েছেন, খালেককে তাঁরা প্রার্থী হিসেবে চাইছেন।

দলীয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গাজীপুরে এবার দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। গত নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী ছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীর তিন মাস ধরে প্রতিটি ওয়ার্ডে সভা করছেন। সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। গত নির্বাচনে ওখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান পরাজিত হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগেও রয়েছে মনোমালিন্য। দলের সাধারণ সম্পাদক মনোমালিন্য কাটিয়ে সেখানে সংগঠন গোছাতে নির্দেশনা দেবেন বলে জানা গেছে।

দলীয় সূত্র মতে, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত এবং ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর মধ্য থেকে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে আওয়ামী লীগ থেকে। এর বাইরে মনোনয়ন প্রত্যাশায় তত্পর আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম। সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণ মারা যাওয়ার পর বরিশালে নতুন প্রার্থী নিয়েই ভাবা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। জানা গেছে, মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এগিয়ে আছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রংপুরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে তত্পর আছেন ১০ জন নেতা। জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেবে কি না তা নিশ্চিত নয়। জাতীয় পার্টির কোন্দলের কারণে সেখানে গত নির্বাচনে ঝন্টু জিতেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। পরে তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে। সেখানে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের একজন হলেন রংপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য এইচ এম আশিকুর রহমানের ছেলে রাশেক রহমান।

Comment here