ক্রাইম

ঢাকায় শত ইয়াবা কারখানা-একদিকে টেকনাফসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে চালান আসছে ঢাকায়;অন্যদিকে অনেকে ঘরবাড়িতে কারখানা গড়ছে

টেকনাফ ভিশন ডেস্ক:ঢাকায় এখনো ধ্বংস করা যায়নি ইয়াবা সাম্রাজ্য। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মাঝে মাঝে অভিযান চালায়। কিন্তু বাস্তবে এখনো ঢাকার প্রতিটি এলাকায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে মানবজীবন ধ্বংসকারী ইয়াবা ট্যাবলেট। কক্সবাজারসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করছে ইয়াবার চালান। চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকায় এখন খোদ রাজধানীতেই তৈরি হচ্ছে ইয়াবা। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, ছোট-বড় মিলিয়ে রাজধানীতেই রয়েছে ইয়াবার শত কারখানা। এর আগে গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় একাধিক ইয়াবার কারখানা ধ্বংস করেছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তারপরও আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কতিপয় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। ব্যবসাও চলছে জমজমাট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়াবা ব্যবসায় জড়িতদের সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় ইয়াবার আগ্রাসন রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তারা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলেছে, বিগত এক বছরে রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকায় ডজন খানেক ইয়াবার কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। কারখানাগুলো থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ইয়াবা তৈরির কম্প্রেসার, মোটর, মিশ্রণের যন্ত্র, স্প্রে মেশিন, কাঁচামাল সোডিয়াম বেনজোয়েট, ক্যাফেইন, ভেনিলা পাউডার ও কেমিক্যালসসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। একই সঙ্গে দেড় ডজন ব্যবসায়ী গ্রেফতার হন। পরে তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ইয়াবা তৈরির চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার খন্দকার নুরুন্নবী জানান, সম্প্রতি ঢাকায় ইয়াবা তৈরির কারখানা পাওয়ায় চিন্তিত পুলিশ। তবে এ মুহূর্তে আমাদের কাছে আরও কারখানা থাকার তথ্য নেই। তবে যেহেতু বিভিন্ন সময়ে কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে এ কারণে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। আশঙ্কা করছি, আরও থাকতে পারে। সন্ধান পাওয়া মাত্রই সেখানে অভিযান চালানো হবে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মাদক উদ্ধার টিমের সদস্যরা কাজ করছেন। সীমান্তপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া নিয়ে ইয়াবা কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। ওইসব কারখানা থেকে উৎপাদিত ইয়াবা দিয়ে চাহিদা মেটানো হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন্স) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই সংস্থার লোকজন কম। এরপরও গোয়েন্দা নজরদারি করা হয়। সংবাদ পাওয়া মাত্র অভিযান চলে মাদকের আখড়ায়। এখনো কারখানার সন্ধান নেই তাদের কাছে।
জানা গেছে,ঢাকায় আলোচিত ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্যরা বরাবরই মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আমদানি করত। কিন্তু গত বছর অক্টোবর থেকে সংঘবদ্ধ এই চক্র খোদ রাজধানী ঢাকাতেই ইয়াবার কারখানা স্থাপন শুরু করে। সেখানে উৎপাদিত লাখ লাখ ইয়াবা প্রতিদিন দেশের বাজারে সরবরাহ হচ্ছে। রাজধানীতেই এখন কয়েক হাজার ব্যবসায়ী তৎপর। সূত্র জানায়, বেশ কিছু দিন ধরে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় মুসলিম গণহত্যার কারণে দলে দলে রোহিঙ্গারা নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। আর এজন্য বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে বিজিবির নজরদারি বেড়ে যায়। সাগরে ট্রলার চলাচলও কমতে থাকে। বিজিবির কঠোর অবস্থানের কারণে টেকনাফ সীমান্ত হয়ে ইয়াবার চালান প্রবেশ করছে ধীরগতিতে। চাহিদা না কমলেও সরবরাহ কমতে থাকে। এ সুযোগে রাজধানীতেই গড়ে উঠছে ইয়াবার কারখানা। গোয়েন্দারা বলছে, ইয়াবার বিশাল চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যবসায়ীরা কারখানা স্থাপন করছে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে ডেমরা এলাকার একটি ফ্ল্যাটে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় ৫ ব্যবসায়ীকে। ব্যাপক জেরার মুখে রাজধানীতে কারখানা স্থাপনের নানা তথ্য ফাঁস করেন তারা। তাদের দেওয়া তথ্য মতেই পুলিশের আশঙ্কা, বাসা বাড়িতে গড়ে তোলা কারখানার সংখ্যা শ’ পেরিয়ে যেতে পারে। পুলিশ এখন সেসব কারখানার সন্ধানে মাঠে নেমেছে।
১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর ডেমরার সারুলিয়ার টেংরা এলাকার মা মেমোরিয়াল স্কুল রোডের আমতলা গলিতে অভিযান চালিয়ে ১১শ’ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ মোহাম্মদ নাসির আহমেদ নামে এক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। ডেমরা থানা পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই বাসায় অভিযানে গেলে জার্মান শেফার্ডের মতো দেখতে একটি কুকুর পুলিশ সদস্যদের ধাওয়া করে। এরপর সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ঢুকে ইয়াবা এবং ইয়াবা তৈরির যন্ত্রপাতি, উপকরণসহ মোহাম্মদ নাসির আহমেদ নামের একজনকে আটক করা হয়। পরদিন ওয়ারী জোনের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের বলেন, এক বছর ধরে ওই বাসায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছিল। প্রতিদিন অন্তত ৫শ’ ইয়াবা তৈরি হতো। চক্রের ৭/৮ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তিনি জানান, আটক নাসির এক সময় ভেষজসহ বিভিন্ন ওষুধ বিক্রি করতেন। বেশি লাভের আশায় পুরনো ব্যবসা ছেড়ে তিনি ইয়াবা তৈরির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ওই বাসা থেকে ইয়াবা তৈরির প্রায় ২৫ কেজি উপাদান জব্দ করা হয়েছে, যা দিয়ে চার লাখ ইয়াবা তৈরি সম্ভব বলে জানান ডিসি ফরিদ উদ্দিন। এর আগে ২৪ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরে ইয়াবা তৈরির কারাখানার সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মিরপুর দুই নম্বরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ৫০০ পিস ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির কারখানার যন্ত্রপাতি ও বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক উপাদান উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় ৫ ইয়াবা ব্যবসায়ীকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজন রসায়নে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ইয়াবা তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। তার নাম জসিমউদ্দিন ওরফে শিমুল (৩২)। গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলেন—সৈয়দ তরিকুল ইসলাম সুমন, আলী আকবর, জুবায়ের হোসেন জুয়েল ও ইশতি আজাদ ওরফে টুটুল। এ ছাড়া রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আরও ৩ ইয়াবা ব্যবসায়ীকে। এরা হলেন—আইয়ুব আলী, শামছুল আলম ও মোস্তাকিন হোসেন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বেশি লাভ আর পুলিশের নজর এড়াতে মিয়ানমারের নাগরিক জনৈক জুবায়েরের নেতৃত্বেও রাজধানীর বুকে ইয়াবা তৈরির কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল আনা হলে ঝুঁকি কম, লাভ বেশি। এর কাঁচামাল সাদা রঙের। ময়দা বা আটা বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সহজেই ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। তাই তারা দেশে ইয়াবা তৈরির পরিকল্পনা আঁটে। নিকেতনে কেনা ফ্ল্যাটেই স্থাপন হয় জুবায়েরের ইয়াবা তৈরির কারখানা। জুবায়েরের বাড়ি কক্সবাজার সদরে বলা হলেও মূলত তিনি মিয়ানমারের নাগরিক। বিয়েশাদি, জীবনযাত্রা, সহায়-সম্পদ সবকিছুই তার মিয়ানমারে বলে জানা গেছে। ইতিপূর্বে এই জুবায়েরের বাসাতেও পুলিশ ইয়াবা তৈরির কারখানা আবিষ্কার করেছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, প্রভাবশালীদের স্বজনরাই পরিচালনা করছেন ‘ইয়াবা’ তৈরির এই কারখানা। তারাই ঢাকাসহ দেশজুড়ে এ মারণঘাতী নেশাজাত দ্রব্যটি বাজারজাতের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক দাপট, প্রশাসনিক ক্ষমতা আর মাদকের অর্থে পরিচালিত এ ইয়াবা চক্রের প্রতাপ আকাশছোঁয়া। তাদের বিরুদ্ধে ‘টুঁ-শব্দটি’ করারও উপায় নেই। এ কারণে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া ইয়াবা কারখানার মালিকরা জানান, সোডিয়াম বেনজোয়েট, ক্যাফেইন ও ভেনিলার পাউডার মিশিয়ে তারা নকল ইয়াবা তৈরি করেন। অনেক সময় ছোট আকারের ওষুধ কোম্পানি থেকে ইয়াবা সাইজের ট্যাবলেট তৈরি করিয়ে সেসব ট্যাবলেটে শুধু ইয়াবার ফ্লেভার (গন্ধ) মিশিয়ে তা বাজারজাত করা হয়। এসব নকল ইয়াবা প্রস্তুত করতে খরচ পড়ে প্রতি পিস ৩০ টাকা। এগুলো পাইকারিভাবে বিক্রি করা হয় ৯০ টাকা থেকে ১১০ টাকা দরে। তবে রাজধানীতে ইয়াবা ট্যাবলেট প্রতি পিস খুচরা বিক্রি হয় আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকায়। মাদকের এই চেইন বাণিজ্যে পুঁজির তিনগুণ লাভে রাতারাতি ধনাঢ্য হয়ে উঠছেন অনেকেই। ফলে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও অন্যান্য পেশার শিক্ষিত অনেকেই ইয়াবা কেনাবেচার কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। ইয়াবার পাইকারি ও খুচরা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা ইয়াবার সঙ্গে ঢাকায় তৈরি ইয়াবার সূক্ষ্ম পার্থক্য বোঝার উপায় নেই। খুব ভালোভাবে পরখ করলে দেখা যায়, রং কিছুটা বদলে যায়, ফ্লেভারও কম থাকে। তবে সেবনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো হেরফের নেই বললেই চলে।

সুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Comment here