আন্তর্জাতিককক্সবাজাররোহিঙ্গা সমাচার

তিন কারণে কিছু রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় স্বদেশে ফিরছে

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ও টেকনাফ প্রতিনিধি


তিন কারণে কিছু রোহিঙ্গা

স্বেচ্ছায় স্বদেশে ফিরছে

মিয়ানমারে সেনা অভিযান শুরুর পর বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে যাচ্ছে। তবে তাদের সংখ্যা কত সেটা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির সূত্রে জানা গেছে, হাজারখানেক রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে গেছে। জেলা প্রশাসক বলছেন, এ সংখ্যা হবে বড়জোর দেড় শ। তবে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) সূত্রে জানা গেছে, গত দুই মাসে ২৯০ জন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় মিয়ানমার ফিরে গেছে।

শরণার্থী শিবির সূত্রে জানা গেছে, তিন কারণে কিছু রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে যাচ্ছে। যারা সহায়-সম্পদ ফেলে এসেছে মূলত তারাই সেনা অভিযান বন্ধের সুযোগে সেগুলো রক্ষা করতে মিয়ানমার ফিরে যাচ্ছে। আর কেউ কেউ নোয়াখালীর ঠেঙ্গারচরে পুনর্বাসনের পরিকল্পনার কথা শুনে স্বদেশে ফিরে যাওয়াকে ভালো মনে করছে। পরিবারের লোকজনের খোঁজ নিতে বা সেখানে রয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের আনতে কিছু রোহিঙ্গা স্বদেশে গেছে। ইতিমধ্যে এখানে ত্রাণ বিতরণের খবর পেয়ে অনেকে বাংলাদেশে চলে আসতে শুরু করেছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বলিবাজার এলাকার লোধাইং গ্রামের একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, নাফ নদের এপার উখিয়া-টেকনাফে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের অনেকেই স্বদেশে ফিরে গেছে। তারা সেখানে গিয়ে চলাফেরায় এমন ভাব দেখাচ্ছে যাতে মনে হচ্ছে তারা দেশ ছেড়ে পালায়নি। মূলত ফেলে যাওয়া সহায়-সম্পদের খোঁজেই তাদের ফিরে আসা।

টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক উলুবনিয়া গ্রামের বাসিন্দা হারুন সিকদার  বলেন, অনুপ্রবেশ করা কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরছে। তবে তাদের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তাও দিনের বেলায় তারা নাফ নদ পাড়ি দিতে পারে না। রাতের বেলায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী পুলিশের (বিজিপি) চোখ ফাঁকি দিয়ে অথবা তাদের ‘ম্যানেজ’ করেই কিছু রোহিঙ্গা আসা-যাওয়া করে থাকে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের যাওয়া-আসা এমনিতেই হরদম রয়েছে। তবে অনুপ্রবেশের সংখ্যার সঙ্গে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সংখ্যা তুলনা করার মতো এখনো হয়নি। ’

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন  বলেন, ‘অনুপ্রবেশ করা কিছুকিছু রোহিঙ্গার স্বদেশ গমনের কথা শুনেছি। তবে তাও ব্যাপক নয়। ইতিমধ্যে বড়জোর শ-দেড়েক রোহিঙ্গা ফিরেছে স্বদেশে। ’

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, গত ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যের বিজিপি চৌকিতে হামলার পর সেখানে সেনা অভিযানের মুখে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বেশ কয়েক সপ্তাহ আগেই ফিরেছে। বিদেশি চাপের মুখে মিয়ানমার বাহিনীর অভিযানে একটু ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে শুরু করে। অনুপ্রবেশ করা অর্থশালী রোহিঙ্গারাই দ্রুত ফিরে গেছে। কেননা পালিয়ে আসার সময় এসব অর্থশালী রোহিঙ্গাদের সহায়-সম্পদ যা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল। এসবের দেখভাল করার তাগিদেই তারা ফিরে যায়।

এ প্রসঙ্গে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের ব্যবস্থাপনা কমিটির সেক্রেটারি রোহিঙ্গা মাঝি মোহাম্মদ নূর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাখাইনের নাফফুরা এলাকার সাতঘইজ্যা পাড়ার চেয়ারম্যান আরাফাত হোসেন সেনা অভিযানের মুখে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কুতুপালং শিবিরে। পরিবারের চার সদস্য নিয়ে তিনিও ইতিমধ্যে স্বদেশে ফিরে গেছেন। ’ তিনি বলেন, আরাফাত একজন অর্থশালী ব্যক্তি। সেখানকার পরিস্থিতি একটু শান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দেশে ফিরে গেছে। এ ছাড়া কুতুপালং থেকে আরো কয়েক শ রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে গেছে বলে মোহাম্মদ নূর জানান।

কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান আবু সৈয়দ জানিয়েছেন, শুধু তাঁর শিবির এলাকা থেকে গত এক মাসে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে গেছে। তাদের নামের তালিকা দিতে কয়েক দিন সময় লাগবে বলে তিনি জানান।

আবু সৈয়দ বলেন, সেখানে শুমারি থেকে বাদ না যাওয়া, বিভিন্ন গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখা টাকা বা সম্পদ সংগ্রহ এবং সেখানে অবস্থান করা পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশে নিয়ে আসা বা খোঁজখবর রাখতে কিছু রোহিঙ্গা স্বদেশে গেছে। ইতিমধ্যে এখানে ত্রাণ বিতরণের খবর পেয়ে অনেকে বাংলাদেশে চলে আসতে শুরু করেছে বলেও জানান তিনি। টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত শিবিরের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দুধু মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত কিছুদিনের মধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গা দেশে ফিরেছে এটা সত্যি। তবে তারা গেছে সেখানে ফেলে আসা সহায়-সম্পদ রক্ষার জন্য। ’

রোহিঙ্গা নাগরিক দুধু মিয়া আরো জানান, সেনা নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা এপারে পালিয়ে আসার সময় তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র, অর্থকড়ি বস্তা বা পলিথিন ভরে বসতভিটায় পুঁতে এসেছিল। সেনা ও তাদের সহযোগীরা মাটি খুঁড়েও সেগুলো নিয়ে যাচ্ছে—এ ধরনের সংবাদ পেয়েই রোহিঙ্গাদের অনেকেই ফিরে যাচ্ছে। আবার অনেকেই ফিরে যাচ্ছে ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে সরকারের পরিকল্পনার বিষয়টি জেনে। কেননা রোহিঙ্গারা ঠেঙ্গারচরে যেতে মোটেই রাজি নয়। ওই চরে যাওয়ার চেয়ে স্বদেশে ফিরে যাওয়াটাই ভালো মনে করছে তারা।

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু সিদ্দিক এ রকম তথ্য দিয়ে জানান, ইতিমধ্যে কুতুপালং থেকে হাজারখানেক রোহিঙ্গা ফিরে গেছে বলে তাঁর ধারণা। অনেকেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে যায়নি। পরিবারের নারী ও শিশুদের এপারে রেখে পরিবারের কর্তারাই কেবল স্বদেশে ফিরছেন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার জাতীয় প্রজেক্ট ম্যানেজার সৈকত বিশ্বাস বলেন, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা পরিবার মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় চলে গেছে এমন তথ্য তাঁর জানা নেই। গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন পেয়ে তিনি এ বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলেও জানান।

টেকনাফ-২ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল ছিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে গত দুই মাসে (৬০ দিন) ২৯০ জন স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে গেছে। বাংলাদেশ থেকে  রোহিঙ্গারা চলে যেতে চাইলে বাধা দেওয়া হচ্ছে না।

Comment here