সংস্কৃতি

নায়করাজের মহাপ্রস্থান

নওশাদ জামিল

নায়করাজের মহাপ্রস্থান

 

২১ আগস্ট। এমনিতেই শোকাবহ দিন। এর মধ্যে যোগ হলো আরেকটি বড় ধরনের শোকের পালক। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় না-ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

স্বজনরা জানিয়েছে, গতকাল হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে রাজ্জাককে নেওয়া হয় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে মৃত্যু হয় তাঁর। হৃদরোগ ছাড়াও তিনি ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস রোগে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন।

নায়করাজের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে চলচ্চিত্র, শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনসহ সর্বত্র নেমে আসে শোকের আবহ। চিত্রনায়ক আলমগীর, শাকিব খান, ওমর সানি, ফেরদৌস, চিত্রনায়িকা মৌসুমী, পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার, শাহ আলম কিরণসহ অনেকেই ছুটে যান হাসপাতালে। শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ অনেকে।

তাঁর মৃত্যুতে তিন দিন শুটিং স্থগিত ঘোষণা করেছে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি।রাজ্জাক স্ত্রী লক্ষ্মী (খায়রুন নেসা), তিন ছেলে বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও সম্রাট এবং দুই মেয়ে শম্পা ও ময়নাকে রেখে গেছেন। তাঁর ছেলেরাও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। সম্রাট হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বাবার জন্য আপনারা দোয়া করুন। তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করুন। আপনাদের এবং দেশবাসীর কাছে এখন সেটাই চাওয়া। ’

গতকাল রাতে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নায়করাজের মরদেহ আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে। এর আগে সকালে এফডিসিতে শ্রদ্ধা জানাবেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের শিল্পী-কলাকুশলীরা। বিকেল ৩টায় গুলশান আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হবে।

পাঁচ শর বেশি চলচ্চিত্রের অভিনেতা রাজ্জাক বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘নায়করাজ’ নামেই খ্যাত ছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সাদা-কালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন যুগ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে প্রায় ২৫ বছর প্রায় একাই টেনে রেখেছিলেন এই চিত্রনায়ক। শেষ দিকে অন্য চরিত্রে অভিনয় করলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন তাঁকে চিরসবুজ নায়ক হিসেবেই দেখত।

নায়করাজের মৃত্যুর খবর শুনে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন রুপালি পর্দায় তাঁর নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম সারাহ বেগম কবরী। গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কবরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুবই কষ্ট হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে আমার। বিশ্বাসই হচ্ছে না, তিনি আমাদের মাঝে নেই। ’

কবরী আরো বলেন, ‘অনেক দিন দেখা হয়নি তাঁর সঙ্গে। ইদানীং খুব বেশি কথাবার্তাও হতো না। ভাবছিলাম তাঁর বাসায় যাব। কেমন যেন সময় হচ্ছিল না। ভাবতেই পারছি না তিনি এভাবে চলে যাবেন। খুবই কষ্ট হচ্ছে। ’

চিত্রনায়ক আলমগীরের কাছে সাংবাদিকরা প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফাদার মারা গেলে আপনি কি প্রতিক্রিয়া দিতে পারতেন?’ চিত্রনায়িকা ববিতা বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুর সংবাদ আমি মানতে পারছি না। ’

প্রিয় সহকর্মীকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ববিতা। তিনি বলেন, ‘‘তাঁর মৃত্যু সংবাদ আমি মানতে পারছি না। কিছুদিন আগে রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। আমি তাঁকে ও ভাবিকে আমার নতুন বাসায় আসার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আমি তাঁকে বলেছিলাম, রাজ্জাক ভাই আমি আপনাকে নিজে রেঁধে খাওয়াব। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমরা থাইল্যান্ডে ঘুরতে যাচ্ছি। ঘুরে এসে তোমার বাসায় যাব। ’’

মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা বলেন, ‘খবর শুনে আমি হতবিহ্বল হয়ে গেছি। শিল্পী হিসেবে তিনি যেমন অসাধারণ ছিলেন, মানুষ হিসেবেও তেমনি বড় মাপের মানুষ ছিলেন। কখনো তাঁর মধ্যে অহমিকা দেখিনি। আমরা তিন-চারটি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছি। তিনি আমার চেয়ে কিছু সিনিয়র ছিলেন। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র নিয়েই তিনি বাঁচতেন। ’

চিত্র পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, ‘উনাকে ভীষণ দরকার ছিল। শ্বাসকষ্টজনিত কারণে এভাবে চলে যাবেন ভাবতে পারিনি। তাঁর অভাবটা কোনো দিনই পূরণ হবার নয়। ’

সুদর্শন রাজ্জাক চিত্রনায়িকা সুচন্দার সঙ্গে নায়কের অভিনয় শুরুর পর শবনম, কবরী, ববিতা, শাবানাসহ তখনকার প্রায় সব অভিনেত্রীকে নিয়ে একের পর এক ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র দেন ঢালিউডকে। এর মধ্যে রাজ্জাক-কবরী জুটি ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আবির্ভাব ঘটে রাজ্জাক-কবরী জুটির। একের পর এক ছবিতে অভিনয় করেছেন তাঁরা। উপহার দিয়েছেন দর্শকনন্দিত বহু চলচ্চিত্র। ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘ঢেউ এর পরে ঢেউ’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র স্বাধীনতার আগে ঢাকাই ছবির জগতে পেয়েছিল বিপুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতার পরে এ জুটি কাজ করে আরো অনেক চলচ্চিত্রে। তখন ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র উপহার দেয় এই জুটি।

বাংলা চলচ্চিত্রকে রাঙিয়ে দেওয়া, স্বর্ণালি যুগের নায়ক রাজ্জাকের জন্ম হয়েছিল ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি সিনেমাপাড়ায়, কলকাতার টালিগঞ্জে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন সিনেমার শুটিং, তারকা নায়ক-নায়িকাদের। খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট নানা কিছু। ফলে অল্প বয়সেই অভিনয়ের বাসনা বাসা বাঁধে তাঁর হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখা শুরু তখন থেকেই। কিশোর বয়সেই জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকে, জড়িয়ে পড়েন অভিনয়ের ঘোরলাগা জগতে। তখন টালিগঞ্জের সিনেমাশিল্পে উত্তম কুমার, সৌমিত্র, ছবি বিশ্বাস প্রমুখ খ্যাতিমানের উড়ন্ত যুগ। তাঁদের চলচ্চিত্র দেখেন আর রাজ্জাক দিনরাত স্বপ্ন দেখেন। কলকাতায় হালকা-পাতলা সাধারণ এক ছেলে রাজ্জাকের অভিনয়ের সুযোগ মিলল না। কে জানত সেই লিকলিকে ছেলেটিই জয় করে নেবে বাংলাদেশের হৃদয়!

রাজ্জাকের মনে যখন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের দুর্নিবার স্বপ্ন, তখনই কলকাতায় শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কলকাতায় থাকাটাই তাঁর জন্য মুশকিল হয়ে পড়ল। তখন এক সুহৃদের পরামর্শে চলে আসেন ঢাকায়। সেটা ১৯৬৪ সালের কথা। ঢাকায় পা রেখেই রাজ্জাক পেতে শুরু করেন বিপুল গ্রহণযোগ্যতা। কলকাতা তাঁকে বিমুখ করেছিল, ঢাকা তাঁকে দুহাত ভরে দিল। এ দেশের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে আপন করে নিল। বাংলাদেশে অল্প সময়েই তিনি পান অসাধারণ খ্যাতি, বিপুল মানুষের ভালোবাসা।

চিরসবুজ নায়ক রাজ্জাকের আসল নাম মো. আবদুর রাজ্জাক। বাবা আকবর হোসেন ও মা মিনারুন্নেসা। ১৯৬২ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিয়ে করেন লক্ষ্মীকে। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্জাক। তিনি তাঁকে ওই সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা ইকবাল ফিল্মসে চাকরি নিয়ে দেন। পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারীর কাজ। সহকারী পরিচালক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম ছবি ‘উজালা’। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’, ‘আখেরী স্টেশন’ ও ‘ডাক বাবু’ ছবিতে ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। বরেণ্য চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের সহকারী হিসেবেও কাজ করেন। এ সময় সুযোগ পান নায়ক হওয়ার।

জহির রায়হান রত্ন চিনতে ভুল করেননি। রাজ্জাককে তিনি নায়ক বানান, সুযোগ দেন তাঁর ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের। ‘বেহুলা’র নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন সুচন্দা। ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বেহুলা’ সুপারহিট হয়। আর রাজ্জাক সুযোগ পেয়ে যান তাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণের। ঢাকার চলচ্চিত্র পায় একজন রোমান্টিক নায়ক, যিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সিনেমাশিল্পের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। চলচ্চিত্রমোদীদের উপহার দেন অসংখ্য কালজয়ী চলচ্চিত্র।

অভিনয়ের পাশাপাশি নায়করাজ ১৯৭৬ সালে ‘আশঙ্কা’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মোট ২০টি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন তিনি। পরিচালনা করেছেন অন্তত ১৬টি চলচ্চিত্র। পরিচালক হিসেবেও তিনি সফল হয়েছেন। সর্বশেষ তিনি ‘আয়না কাহিনী’ ছবিটি নির্মাণ করেন।

‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘রংবাজ’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ‘পিচঢালা পথ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘অবুঝ মন’, ‘আনারকলি’, ‘নাতবউ’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘কালো গোলাপ’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক। সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ছেলে বাপ্পারাজ পরিচালিত ‘কার্তুজ’ ছবিতে।

অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় তাঁকে। ২০১৫ সালে তিনি পান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার। প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ‘কী যে করি’ ছবিতে অভিনয় করে। এরপর আরো চারবার তিনি জাতীয় সম্মাননা পান। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্যবার। এ ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক : রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ শোকবার্তায় বলেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তা অর্জনে নায়করাজ রাজ্জাকের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাঙালি সংস্কৃতি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্মরণ করবে। ’

শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ’

Comment here