আন্তর্জাতিককক্সবাজাররোহিঙ্গা সমাচার

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি অপরিবর্তিত

 

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, টেকনাফ: বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যে দিনপার করছে উভয় সীমান্তের অধিবাসীরা। শনিবার সকালে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে লোকজন। বাংলাাদেশ সীমান্তে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা। এতে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় অনুপ্রবেশ না ঘটলেও বৃহস্পতিবার রাতে ও  শুক্রবার ভোরে বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে হাজার খানেক রোহিঙ্গা।

যদিও বিজিবি বৃহস্পতিবার সকালে ১৪৬ জন রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। এদিকে শনিবার ভোরেও বিজিবি টহল দলকে ফাঁকি দিয়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে শনিবার সন্ধ্যায় নারী ও শিশুসহ ৬৭ জন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ।

তবে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশের খবর পাওয়া গেছে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম ও কক্সবাজার জেলার উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের সংযোগস্থল আমতলি এলাকা দিয়ে।

দু’দেশের দুর্গম, পাহাড়ি এ আমতলি এলাকা স্থল সীমান্ত হওয়ায় রোহিঙ্গা পায়ে হেটে দলে দলে চলে আসছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

আমতলি এলাকার বাংলাদেশি বাসিন্দা ফরিদ আলম (৪৬) শীর্ষনিউজকে জানিয়েছেন, যেভাবে রোহিঙ্গা  আসছে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকার ও পাহাড়ি পথ এবং স্ট্যান্ডবাই বিজিবি টহল না থাকায় আমতলি দিয়ে অনুপ্রবেশের বাড়ছে।

গতকাল শুক্রবার রাত ২টা থেকে ৩টার সময় এবং শনিবার ফজরের নামাজের পর পরই প্রায় ২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।

শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার সময় ওই এলাকায় কথা হয় মিয়ানমারের ফকিরাবাজার কামউসি পাড়ার রশিদা খাতুনের (৪০) সাথে । স্বামী এজাহার মিয়া মারা যান ১১ বছর আগে। ৫ সন্তানের জননী রশিদা। তাদের স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে রওয়ানা দেন বাংলাদেশের দিকে।

তিনি জানান, ওই রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনে ঘুম থেকে ওঠেন রাত ২টার সময়। এরপর দিকবিদিক ছুটতে থাকেন সবাই। ছেলে, ছেলের বৌ ও নাতিরা কে কোথায়- এর হদিস নেই।

পরে অন্যদের সাথে পাহাড়ি পথ ও ঝড় বৃষ্টির মধ্যে হেটে ১৮/২০ কিলোমিটার পথ ৩৩ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে শনিবার বেলা ১১টায় বাংলদেশে পৌঁছেন রশিদা।

তিনি বলছিলেন, ‘এখন কোনভাবে কুতুপালং ক্যাম্পে পৌঁছতে পারলেই আল্লাহ বাঁচায়।’

কথা হয় মিয়ানমারের একই এলাকার আলী হোসেনের ছেলে নুরুল কবিরের (৫০) সাথে।

তিনি শীর্ষনিউজকে বলেন, মিয়ানমারের মিলিটারির অত্যাচার নির্যাতনের ভয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা খেয়ে না খেয়ে অবস্থান করছে। সময় সুযোগ পেলেই তারা বাংলাদেশে চলে আসবে। ওখানে কোনও নিরাপত্তা নেই জীবনের। নেই কোনও কাজকর্মও।

শনিবার সকালে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং বাজারে কথা হয় মিয়ানমারের নাইচাডং এলাকা থেকে আসা মোঃ আব্দুল্লাহর (৩০) সাথে।

তিনি শীর্ষনিউজকে বলেন, ভোরে হোয়াইক্যং খারাইগ্যা ঘোনা এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। এই মাত্র স্ত্রী, দু’বোন ও মাকে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছি। কোথাও কোনও অসুবিধা হয়নি। কারণ ওই সময় ওখানে বিজিবি সদস্যরা টহলে ছিলো না।

আব্দুল্লাহ আরো বলেন, মা-বোনেরা কুতুপালংয়ে পৌঁছে গেলেও সে হোয়াইক্যংয়ে রয়ে গেছেন টাকা পয়সা সংগ্রহ করার জন্য।

প্রয়োজনে তিনি আবারও মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সহায় সম্পত্তির খোঁজ খবর নিবেন বলেও জানান তিনি।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে উখিয়া-টেকনাফে প্রশাসনের সভা
এদিকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শুক্রবার রাতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জরুরি সভা করেন। সভায় সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কোস্ট গার্ড, বিজিবি’র টহল জোরদারের পাশাপাশি লোকালয়ে পুলিশি টহল বাড়ানোর সিদ্বান্ত নেয়া হয়। এ কাজে প্রশাসনের সাথে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সমন্বিত উদ্যোগ নিতে সীমান্তবর্তী  উপজেলা প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়।

এর সূত্র ধরে শনিবার দুপুরে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আনোয়ার”ল নাসের, সহকারী পুলিশ সুপার (উখিয়া-টেকনাফ সার্কেল) চাইলাউ প্রো মারমাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

একইভাবে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাইন উদ্দিনের সভাপতিত্বে শনিবারে অনুষ্ঠিত সভায় জেলা প্রশাসক আলী হোসেন ও পুলিশ সুপার ড. এ কেএম ইকবাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

এ সভায় কঠোর হস্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি অনুপ্রবেশে সহযোগী দালালদের চিহ্নিত করতে বলা হয়। প্রয়োজনে অনুপ্রবেশে জড়িতদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি বিধান করার সিদ্বান্ত নেয়া হয়।

কোস্টগার্ড ও বিজিবির  টহল জোরদার: ৭৩ রোহিঙ্গাকে ফেরত

কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদী ও অস্থায়ী চেকপোস্টে ৭৩ রোহিঙ্গাকে আটক করে কোস্টগার্ড ও পুলিশ। পরে আটক রোহিঙ্গাদের টেকনাফের সাবরাং নয়াপাড়া ও হোয়াইক্যং নাফনদী সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করা হয়েছে বলে জানায়। তবে নাফ-নদীতে বিজিবি ও কোস্টগার্ড টহল অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা বন্ধে সেন্টমার্টিনে মাইকিং করা হয়েছে। তবে রাতের আধারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কিছু কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে জানা গেছে।

এদিকে ২৬ আগস্ট শনিবার দুপুর ১২টার দিকে টেকনাফের মিয়ানমার জেটি ঘাটে কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার জাফর ইমাম সজীব সাংবাদিকদের জানান, শনিবার ভোর ৪টার দিকে আমিসহ কোস্টগার্ড শাহপরীরদ্বীপ স্টেশন কমান্ডার কবিরের নেতৃত্বে পৃথক টিম নাফ নদীতে টহলকালে সাবরাং নয়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে ৫৬ জন রোহিঙ্গা বোঝায় একটি ট্রলার অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের আটক করা হয়।

পরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এ সব রোহিঙ্গা বোঝায় ট্রলারটি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এতে ২১ জন নারী, ২১ জন শিশু ও ১৪ জন পুরুষ ছিল বলে জানায়। এ সময় কিছু দূরে আরো ৮ থেকে ১০টি ট্রলার দেখা গেলেও কোস্টগার্ডের বাধার মুখে রোহিঙ্গা বোঝায় ট্রলার সমূহ মিয়ানমারের ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

তিনি আরও জানান, মিয়ানমারে ঘটনার পর থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় নাফ নদীতে কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে।

সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নদীতে কোস্টগার্ডের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনর্চাজ (ওসি) মাইন উদ্দীন খান জানান, একইদিন ভোর রাতে টেকনাফ হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির আইসি উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহির খানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ হোয়াইক্যং পুলিশ ফাড়ির সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে বিভিন্ন গাড়ি তল্লাশি চালিয়ে অনুপ্রবেশকারী ১৭ মিয়ানমার রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫জন নারী, ৫ শিশু ও ৭ জন পুরুষ রয়েছে।

আটক রোহিঙ্গারা রাতের আধারে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে লোকালয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিল। পরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আটক ১৭ মিয়ানমার রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিজিবির মাধ্যমে হোয়াইক্যং সীমান্ত দিয়ে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলেও জানান ওসি।

তিনি আরো জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা তৎপর রয়েছে। তবে লোকালয়ে যাতে কোনও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে দিকে নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া কমিউনিটি পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্ব-স্ব এলাকায় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। তাছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে অস্থায়ী চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

তাছাড়া শুক্রবার রাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, কোস্টগার্ড ও নৌ বাহিনীর বরাদ দিয়ে মাইকিং করে সাগরে মাছ ধরার ট্রলার সমূহ যেতে নিষেধ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে বলেও মাইকে এমন প্রচারণা চালানো হয়। এই তথ্য নিশ্চিত করেন সেন্টমাটিন ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ।

শনিবার ভোরে টেকনাফ মডেল থানা হতে হস্থান্তর অনুপ্রবেশকারী ১৭ মিয়ানমার রোহিঙ্গা নাগরিককে হোয়াইক্যং সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠানো হয় বলে জানান বিজিবির সিও লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম।

তিনি জানান, নাফ নদী সীমান্ত অতিক্রম করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা বিদ্যমান থাকায় বিজিবি পোস্ট ও টহল জোরদার করা হয়েছে। তবে সীমান্ত এলাকা সমূহে বিজিবির সতর্ক অবস্থান রয়েছে বলে জানান।

Comment here