এক্সক্লুসিভসারাদেশ

“বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু”

“বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু”
মোঃ আদিল মাহমুদ
১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস এবং বেদনা-বিধুর একমাত্র দিন। প্রতিবছর জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাবে এ দিনমানটি মনঃকষ্টের সাথে পালন করা হয়। এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বীর বাঙ্গালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫ তম শাহাদাত বার্ষিকী।

বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্বের জঘণ্যতম কলঙ্কিত কালো দিবস এ ১৫ আগষ্ট। ১৯৭৫ সালের হৃদয় বিদারক শোকাবহ এ দিনের ভোর রাত্রে পৃথিবীর বুকে ঘটে যায় এক জ্বালাময়ী হত্যাযজ্ঞ, যা বার বার মনে করে দেয়, কারো উপকারে এসো না, এসো না! কারণ, যাদের জন্য তুমি নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করছো, তাদের কেউ কেউ তোমায় বাচঁতে দিবে না। কৃতজ্ঞতা বোধ বলতে কিছু নেই! যা আছে তার সবকিছুই স্বার্থের খুব গভীরে নিহিত।

দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য বঙ্গবন্ধু যা করেছেন তাঁর ফল তিনি পেয়েছেন তাঁর বুকের তাজা রক্ত দিয়েই শুধু নয়! পেয়েছেন তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলুতুন্নেছা মুজিব, আদরের শিশু সন্তান শেখ রাসেল, শেখ জামাল, শেখ কামাল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামালের রক্তিম রক্তের বিনিময়ে!

পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া কলঙ্কিত, ঘৃণিত এ বারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যদের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহপরিবারে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে শহীদ হন। শুধু এ অপরাধই বাংলাদেশের বুকে কলঙ্ক বয়ে আনে নি! তার সাথে আরেকটা বড় পাপ যুক্ত হয় যখন, এ জঘণ্যতম হত্যাকান্ডের বিচার রহিত করার জন্য ঘৃণিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করা হয়। অখিলের এ কলঙ্কময় অধ্যায় থেকে বাচঁতে পারেননি জাতির পিতার অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি, সুকান্তবাবু, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি, অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, আব্দুল নাঈম খান রিন্টু, কর্নেল জামিল সহ ১৬ জন ঘনিষ্ট জন। কিন্তু ভাগ্যগুণে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে অবস্হান করায় প্রাণে বেচেঁ যান।

এতো বড় মর্মাত্তিক ঘটনা ঘটিয়েও তারা ক্ষান্ত হয়নি! তারা জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর চার সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, কামরুজ্জামান এবং এম, মনছুর আলীকেও হত্যা করে। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকেও যে হত্যার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করেছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা! খন্দকার মোশতাক আহমদ ইনডেমনিটি জারি করে এ ১৫ আগষ্টের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচারের পথ রুদ্ধ করেন। আর এ জঘণ্যতম অধ্যাদেশটি বাতিল করতে বাংলা দেশকে ধর্য্য ধরে একুশটা বৎসর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমি কোন মুক্তিযোদ্ধা নই। কারণ, এ সময় আমি আমার মায়ের নিকটবর্তী ছিলাম এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতাম। বুদ্ধি ছিলো না, ছোট ছিলাম। তাই, ওই দিনের ধংসযজ্ঞের প্রতিবাদ করতে পারিনি। যদি পারতাম, তবে একাই রাজপথে নেমে ওই ১৭ জনের সাথে আমি ১৮ তম শহীদ হতাম। কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য যে, আমি অবুঝ ছিলাম!

যে মানুষটা দিনের পর দিন না খেয়ে, শতো অত্যাচার সহ্য করে, বেশির ভাগ সময় জেল খেটে বাংলার স্বাধীনতার জন্য প্রাণ-পণ পরিশ্রম করে গেলেন, তার এ অক্লান্ত কষ্টের ফসল কি এ ভয়ানক, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ? এ হত্যাযজ্ঞ প্রমাণ করে, আমরা কেহ-ই বিবেক, বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণী নই! আমরা সবাই কম-বেশি অপরাধী। নিজের বিবেককে প্রশ্ন করলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

জাতির পিতাকে সহপরিবারে নৃশংস ভাবে হত্যার পর তারই সুযোগ্য কন্যা, বর্তমানে বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জার্মানি থেকে দেশে আসার জন্য জার্মানির একটা এয়ারপোর্টে ওনার পাসপোর্টটা ইমিগ্রেশন অফিসারকে দেখালে, ওই ইমিগ্রেশন অফিসার বলেছিলেন, “ছিঃ তোমরা বাংলাদেশীরা জঘন্য একটা জাতি। যে মানুষটা তোমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে ছিলেন তাকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে”? সে দিন শেখ হাসিনার আর্তনাদে, ওই এয়ারপোর্টে সবাই কেঁদেছিলো। সুতারাং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের ঘটনা কোনোদিন বাঙ্গালী জাতি ভুলার কথা নয়!

জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল ও জাতিসংঘের নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে, “ফ্রেন্ড অব দ্যা ওয়ার্ল্ড বা বিশ্ব বন্ধু” হিসেবে অভিহিত করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালের ৬ জুন বঙ্গবন্ধুকে বড় মাপের নেতা আখ্যা দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বঙ্গবন্ধুকে সাহসী নেতা আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, “আই স্যালুট দ্যা ব্রেভ লিডার অব অল টাইমস”। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং লিখেছেন, “প্রিয় শেখ মুজিব, মানুষ বলে তুমি মৃত। কিন্তু আমি অনুভব করি তুমি আজও আমাদের চারপাশে। আমি খুশির সঙ্গে জানাতে চাই যে তোমার স্বপ্ন আজ তোমার মেয়ে শেখ হাসিনার দ্বারা পূরণ হয়েছে। তুমি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মন জয় করেছো। তুমি কেবল বঙ্গবন্ধু নও, ভুটানেরও বন্ধু”। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাহথ্রিপালা সিরিসেনা বঙ্গবন্ধুকে এই অঞ্চলের মহান নেতা আখ্যা দিয়ে বলেন, তার ত্যাগ বাঙালীজাতিকে উজ্জীবিত করে যাবে। শ্রীলংকার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গা বঙ্গবন্ধু যাদুঘর ঘুরে লিখে গেছেন, এ এক গভীর মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, “বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু”। বঙ্গবন্ধু যাদুঘর পরিদর্শন করে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো তারো জাপানি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে গেছেন। ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট, কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী, মিশরের শিক্ষামন্ত্রী, নাইজেরিয়ার শিক্ষামন্ত্রীসহ বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিরা তাদের অনুভূতির কথা লিখে গেছেন। বিশ্ব নেতাদের অনেকেই তাদের নিজের ভাষায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে গেছেন। চীনা, আরবী, হিন্দি, জাপানী, উর্দ্ধু সহ নানা ভাষায় তারা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।

বাংলাদেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি। সেই বাড়িই বাঙালীর তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬১ সালের ০১ অক্টোবর থেকে এ বাড়িতে বসবাস শুরু করেছিলেন। আর এ বাড়িতেই স্বপরিবারে আজকের ১৫ আগষ্ট কালো দিবসে শহীদ হন।
এ মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, বিশ্ব নেতাদের কিছু উক্তি তুলে ধরছি—-
১/ “আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি”– (ফিদেল ক্যাস্ট্রো)।
২/ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না—
(হেনরি কিসিঞ্জার)।
৩/ শেখ মুজিবকে চর্তুদশ লুইয়ের সাথে তুলনা করা যায়। জনগন তাঁর কাছে এতো প্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবী করতে পারেন আমিই রাষ্ট্র—
(পশ্চিম জার্মানী পত্রিকা)।
৪/ শেখ মুজিব নিহিত হলেন তার নিজেরই বিপদগামী সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানীরা সংকোচবোধ করেছে— ( বিবিসি ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫)।
৫/ “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর”—
(সাদ্দাম হোসেন)।
৬/ “শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে”—
( ফিদেল ক্যাস্ট্রো)।
৭/ “আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কসুম কোমল ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য”—
(ইয়াসির আরাফাত)।
৮/ “মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোন জঘন্য কাজ করতে পারে”—
(নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট)।
৯/ “শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।”—
(কেনেথা কাউন্ডা)।
১০/ “শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।”—
(ইন্দিরা গান্ধী)।
১১/ “বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয় নি বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।”–জেমসলামন্ড, ইংলিশ এম,পি।
১২/ “শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।”–প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান।
১৩/ “মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।”–ফিনান্সিয়াল টাইমস।
১৪/ ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বানী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে,”যিশু মারা গেছেন। এখন লক্ষ লক্ষ লোক ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করছে।” মূলত মুজিবকেই তারা যিশুর ভূমিকায় মানছেন—-।
১৫/ একই দিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।”
১৬/ নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেওয়া হয়, “পয়েট অফ পলিটিক্স বলে।”
১৭/ বৃটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, “শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্যা ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা।”
১৮/ জাপানী মুক্তি ফুকিউরা আজও বাঙালী দেখলে বলে বেড়ান, “তুমি বাংলার লোক? আমি কিন্তু তোমাদের জয় বাংলা দেখেছি। শেখ মুজিব দেখেছি। জানো এশিয়ায় তোমাদের শেখ মুজিবের মতো সিংহ হ্নিদয়বান নেতার জন্ম হবেনা বহুকাল।”
১৯/ মরহুম মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীও বলেছিলেন, “টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর একদিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙালির তীর্থস্থানের মতো রূপলাভ করবে”।
২০/ বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার সংবাদ শুনে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতোটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “তোমরা আমার-ই দেয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি”।

পরিশেষে বলতে চাই, সীমালঙ্ঘনকারীকে স্বয়ং আল্লাহ্ পছন্দ করেন না। আর ওই ১৫ আগস্ট এর কালো দিবসে যে হাজারো সীমালঙ্ঘিত হয়েছিলো এ বাঙলার মাটিতে, তার বিন্দুমাত্র ক্ষমা এ পৃথিবীতে থাকার কথা নয়!!

লেখক: পুলিশ ইন্সপেক্টর (তদন্ত)
পরশুরাম মডেল থানা, ফেনী জেলা।

Comment here