জাতীয়

বেদনাবিধুর কালো দিন আজ

হাসান শান্তনু :
আজ সেই ভয়াল ও রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট। জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাবিধুর কালো দিন। জাতির গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিন আজ। ১৯৭৫ সালের এই দিনে শুধু বাঙালির ইতিহাসে নয়, মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর অধ্যায় রচিত হয়।

বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং বাঙালির নিরন্তর প্রেরণার চিরন্তন উৎস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেদিন পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হয়।

আজ জাতীয় শোক দিবস। বিশ্বের লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সব অনুভূতি, ত্যাগ, সংগ্রাম, বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব, অদম্য স্পৃহা, দৃঢ় প্রত্যয়, গভীর ভালোবাসা, মমত্ববোধ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও আদর্শের দ্বারা পুরো জাতিকে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত আত্মত্যাগে দীক্ষিত করে তোলেন। তিনি বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক। বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটি ও মানুষের পরম আত্মীয়, শত বছরের ঘোর নিশীথিনীর তিমিরবিদারী অরুণ এবং ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী স্রষ্টা। বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন, যে বন্ধন কোনোদিন ছিন্ন হওয়ার নয়। তাই তাকে হারানোর দিনে পুরো জাতি গভীর শ্রদ্ধায় নত হবে। শোকার্ত শ্রদ্ধা জানাবে ১৫ আগস্টে নিহত সব শহীদের প্রতি।

অন্য বছরের মতো এবারো যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালন করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটি। সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। শোকাবহ এই দিনে পুরো জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যথাযোগ্য মর্যাদা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভাবগম্ভীর আর বেদনাবিধুর পরিবেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শোক দিবস পালন করবে। দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করেছে।

১৫ আগস্টের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ও মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ ছেলে ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় ছেলে শেখ জামাল, ছোট ছেলে ও নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছোট ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিহত হন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান।

১৫ আগস্টের নরপিশাচ ও ঘাতকরা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি আইন জারি করে। দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালি জাতি বিচারহীনতার কলঙ্ককের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হতে থাকে। তারা ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা উদ্যোগ নেয়। শাসকদের রোষানলে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও নিষিদ্ধ হয়। জাতির পিতার তনয়া ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে দলটি সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের নানা বাধা দূর করে। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে জাতির যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের পথও তখন সুগম হয়।

১৯৯৮ সালে প্রথম বিচারিক আদালত সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পরে উচ্চ আদালত তাদের তিনজনকে বেকসুর খালাস দেন। সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে মানবতার শত্রু, নরপিশাচ ও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর হলেও জাতি পিতৃহত্যার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়। তবে বিভিন্ন দেশে পলাতক থাকায় আরো ছয় খুনির সাজা এখনো কার্যকর করা যায়নি।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্মলাভ, ’৪৮-এর মার্চে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন, ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম, ’৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের ৬-দফা, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১১-দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়সহ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা চূড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। ’৭১ সালের ৭ মার্চ তার ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিশপথে ঐক্যবদ্ধ হয় বাঙালি জাতি। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। তার কালজয়ী নেতৃত্বে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গে উজ্জীবিত ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনিই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আজ বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয়ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এ ছাড়া দেশের সব সরকারি হাসপাতালে দিবসটি উপলক্ষে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। চিকিৎসকরা আজ ব্যক্তিগত চেম্বারেও বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেবেন। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভিসহ সব বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং সংস্থাও জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নানা কর্মসূচির আয়োজন করবে।

এবারের শোক দিবস পালনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আজ দিনের শুরুতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সংগঠনের সব স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা জানানোর পর আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানাবে।

এরপর সকাল সাড়ে ৭টায় ঢাকার বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানো হবে। বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ অন্যান্য উপাসনালয়ে হবে বিশেষ প্রার্থনা। এর অংশ হিসেবে সকাল ৯টায় রাজধানীর মিরপুর-১০-এর সেনপাড়া পর্বতায় ওয়াইএমসিএ চ্যাপেলে খ্রিস্টান সম্প্রদায়, সকাল ১০টায় ঢাকার মেরুল বাড্ডা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছে।

বাদ আসর মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল হবে। এদিন দুপুরে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা হবে

দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আগামীকাল শুক্রবার বিকালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে দেশবাসীকে নিয়ে পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সংস্থাগুলোর সব স্তরের নেতাকর্মী, সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগের সব জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডসহ সব শাখাকে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে দিবসটি পালন করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

Comment here