জাতীয়

শামসুল হুদা : সবাই রাস্তায় নেমে আসে, ১৪৪ ধারা হাওয়ায় উবে যায়

 

তৌফিক মারুফ

সবাই রাস্তায় নেমে আসে, ১৪৪ ধারা হাওয়ায় উবে যায়

অ- অ+

‘পিছুটান কাটিয়ে তারুণ্যে উজ্জীবিত ছিলাম বলেই মাতৃভাষার জয় পেয়েছিলাম। বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা সেদিন আমাদের দমিয়ে রাখতে পারেননি। গুলির ভয় তো মাথায়ই রাখিনি। বিশেষ করে যেদিন উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার জন্য খাজা নাজিমুদ্দিনের জোরালো কণ্ঠ শুনলাম, তখন থেকেই রক্ত আরো টগবগিয়ে উঠেছিল। একজন বাঙালি হয়েও ব্যাটা বাংলার পক্ষে না থেকে কিভাবে উর্দুর পক্ষে কথা বলল—সেটাই ছিল রাগ। ’ বায়ান্নর সাহসী তরুণ ভাষাসৈনিক শামসুল হুদা ৮৫ বছরে এসেও যেন একই দৃঢ়তার সঙ্গে স্মৃতিচারণা করলেন ভাষা আন্দোলনের সেসব দিনের কথা। গত শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর বায়তুল আমান হাউজিংয়ের বাসায় বসে উত্তাল দিনের আরো অনেক স্মৃতি তিনি মেলে ধরলেন কালের কণ্ঠ’র কাছে।

শামসুল হুদা বললেন, ‘সব আন্দোলন সংগ্রামেই একটি অংশ থাকে—যারা সামনে এগোতে চায় না বরং অন্যদেরও দমিয়ে রাখতে চায়। ভাষা আন্দোলনেও তেমনটা হয়েছিল। প্রথম যেদিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব তুলেছিলেন সেদিনও অনেক বড় বড় বাঙালি নেতা তাঁকে সমর্থন করেননি। আবার যখন বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি ঘিরে তত্কালীন পাকিস্তান সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দেয়, তখন আমাদের মুরব্বি সংগঠনের নেতারা ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ২০ তারিখ রাতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সভায় (ভাসানীর অনুপস্থিতিতে) সভাপতিত্ব করেন আবুল হাসেম। তিনিসহ ওই সভার সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমনকি ২১ তারিখ সকাল সাড়ে ৯টায় আমরা যখন জমায়েত হয়ে মিছিল নিয়ে বের হতে যাব তখনও শামসুল হক আর খন্দকার মোশতাক সেখানে এসে আমাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন ভিসিও বারণ করেছিলেন। তবে সব বাধা উপেক্ষা করে আমরা গ্রুপ গ্রুপ করে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমি ছিলাম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সঙ্গে। আমাদের গ্রুপ পুকুর পাড় হয়ে সামনে যেতেই পুলিশ আমাদের ঘিরে ফেলে। প্রায় তিন ঘণ্টা সেখানে আমাদের আটকে রাখে। এর মধ্যেই গুলির শব্দ শুনতে পাই। উঁকি দিয়ে দেখি মানুষের ছোটাছুটি। গুলির পর অটোমেটিকভাবেই সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এক হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। ১৪৪ ধারা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পুলিশ দ্রুত আমাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। ’

এই ভাষাসংগ্রামী জানান, ‘ভাষা আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের অনেকেরই নাম আজও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। কেবল চার-পাঁচটি নামই বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ওই দিন আরো বেশি মানুষ মারা গেছে। এমনকি পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারিও নবাবপুর রোডে আরো চারজন মারা যায়। আবার ২১ তারিখ গুলির পর সলিমুল্লাহ হলে থাকা ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করলে সেখানেও পাকিস্তানি মিলিটারি অভিযান চালায়। এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার দরকার আছে। ’

শামসুল হুদা বললেন, ‘আমি জেল থেকে ছাড়া পাই ছয় মাস পর। আমি ছিলাম ইংরেজি অনার্সের ছাত্র। জেল থেকে ফিরে ক্লাস করতে গেলে দেখি আমার শিক্ষক নাম কেটে দিয়েছেন, কারণ আমি নাকি ইংরেজি পারব না। আমার আর অনার্স করা হলো না। শেষ পর্যন্ত সাধারণ বিএ পাস করলাম। পরে অবশ্য করাচিতে আবার অনার্স ও অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স করে দেশে ফিরে আরেক ঝামেলায় পড়লাম। আমার সঙ্গে সবাই সিএসপি অফিসার হতে পারলেও আমি হতে পারিনি। বাধ্য হয়ে অন্য পদে চাকরি নিতে হয়েছে। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে অবসরে যাই পর্যটন করপোরেশন থেকে। ’

সেদিন যে চেতনা থেকে আন্দোলন করেছিলেন তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন আজও হয়নি দেখে আক্ষেপ করলেন শামসুল হুদা। বললেন, ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা বাস্তবায়নে আইন করা হলেও ওই আইনে গলদ থেকে যায়। আইনটিতে প্রথাগতভাবে আগের আইনগুলোর সংশ্লিষ্ট ধারা একীভূত করার বা বাদ দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে এই সুযোগ ব্যবহার করে এখনো অফিস-আদালতে বাংলাকে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। সব কিছুই ইংরেজিতে হয়। এমনকি আইনগুলোও হয় ইংরেজিতে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কার্যকর তেমন পদক্ষেপ নেই। একই সঙ্গে এখন আইনপ্রণেতারাও সংবিধান অবজ্ঞা করছেন। কারণ সংবিধানে আছে রাষ্ট্রের ভাষা হবে বাংলা। তাই সেই সংসদ থেকে কিভাবে ইংরেজিতে আইন অনুমোদন হয়! রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে একুশে পদক পেয়েছেন শামসুল হুদা। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে এ পর্যন্ত আশিটিরও বেশি সংবর্ধনা পেয়েছেন। জানালেন, এখন শুধু তাঁর একটাই ইচ্ছা—সর্বস্তরে বাংলা ভাষার সত্যিকারের প্রয়োগ। তবেই শান্তি পাবেন।

Comment here