ক্রাইম

সক্রিয় জালনোট চক্র

আজাদ হোসেন সুমন :

ঈদ এলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে একাধিক জালনোট চক্র। এ সময় কোটি কোটি জাল টাকা বাজারে ছাড়ার মিশন নিয়ে মাঠে নামে তারা। এ অপরাধী চক্রের সদস্য বিভিন্ন সময় আটক হলেও জামিনে বেরিয়ে ফের লিপ্ত হয় একই কাজে। সম্প্রতি র্যাব গোয়েন্দা পুলিশ পাকড়াও করেছে একাধিক সংঘবদ্ধ জালনোট চক্রের সদস্যদের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্যমতে, এখনো এসব সংঘবদ্ধ চক্রের কমপক্ষে ২০ সদস্য পলাতক রয়েছে। র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ এদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পলাতক সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে না পারলে আরো জালনোট তারা বাজারে ছেড়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশি টাকা ছাড়াও সংঘবদ্ধ চক্রগুলো ভারতীয় রুপি জাল করে তুলে দিচ্ছে সীমান্ত এলাকার ভারতীয় সিন্ডিকেটের হাতে। তারা এক লাখ জাল রুপি ১২ হাজার টাকায় কিনে সেই রুপি ভারতের বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। গত ২০১৭ সালে ভারতীয় রুপির ছড়াছড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে একটি টাস্কফোর্স বাংলাদেশে আসে। টাস্কফোর্সের সদস্যরা বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে দিনব্যাপী বৈঠক করে ভারতীয় জাল রুপি কীভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকছে তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানায়। ওই সময় বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বদানকারী তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোখলেসুর রহমান দ্রুত দেশজুড়ে সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। একের পর পুলিশি অভিযানে রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে একাধিক চক্র ধরা পড়ে। র্যাব-পুলিশের অব্যাহত অভিযানের মুখে চক্রগুলোর ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ে। কিন্তু ওই ওই অভিযানের ছয় মাস যেতে না যেতেই টাকা ও রুপি জালকারী চক্রের পেশাদার সদস্যরা আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবারের ঈদকে সামনে রেখে তারা আবারো কোটি কোটি টাকা ও রুপি জাল করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, কোটি টাকার জাল নোট নিয়ে এসব চক্র মূলত মার্কেট ও বিপণিবিতানগুলো টার্গেট করেছে। বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথে জাল টাকা দিতে এসব প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কিছু অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাও। সবচেয়ে আঁতকে ওঠার মতো বিষয় হচ্ছে—উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে টাকার মূল্যমান বাড়াতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরাতন আসল টাকার ওপর ছাপ বসানো হয়, যা জাল টাকা শনাক্তকারী মেশিনও অনেক সময় ধরতে পারে না। এভাবে ১০০ টাকার নোটকে ৫০০ টাকার জাল নোটে রূপান্তরিত করা হয়। ফলে প্রতিটি টাকার নোট চোখে দেখে শনাক্ত করাও সম্ভব হয় না অনেকের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাল টাকা তৈরি ও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে রাজধানীতেই অন্তত ৩৫টি চক্র সক্রিয়। এর আগে গত ৮ জুন রাজধানীর মিরপুরের একটি ভাড়া বাসা থেকে ছাপা ও অর্ধছাপা বাংলাদেশি ১০০০ ও ৫০০ টাকা মূল্যমানের বিপুল পরিমাণ জাল নোট, জাল নোট তৈরির কাগজ, ১২টি ফ্রেম, রং, নিরাপত্তায় ব্যবহূত থ্রেট সুতা, ৩টি ল্যাপটপ, ১টি ডেস্কটপ কম্পিউটার, ৩টি প্রিন্টার, ১২ বান্ডিল ১০০০ ও ৫০০ টাকা লেখা জলছাপ দেওয়া কাগজ, ২টি কার্টার ও অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এ সময় চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবি পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম জানান, আটকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার জালনোট বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিল। তিনি জানান, ইতোমধ্যে বেশ কিছু টাকা তারা বাজারে ছেড়েছে।

এদিকে ৪০ লাখ টাকার জালনোটসহ চক্রের একটি গ্রুপের দলনেতাসহ ৬ জনকে গত শনিবার রাতে গ্রেপ্তার করে মহানগর ডিবি পুলিশ। অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া হাওলাদার সোহেল, মাজহারুল ইসলাম, আলামিন, আরিফ আরমান নিপু, শফিকুল ইসলাম ও সোহেল মিয়া জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা আগেই ৬০ লাখ টাকার জালনোট বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। এর আগে ৫০ লাখ টাকা ও তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল আরেকটি চক্র। ওই চক্রটি প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার জালনোট বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিল।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে ছাপা-অর্ধছাপা বাংলাদেশি ১০০০ টাকা মূল্যমানের ৪০ লাখ টাকার জালনোটসহ বিপুল পরিমাণ টাকা তৈরির কাগজ, জাল টাকা তৈরির ৮টি ফ্রেম, রং, নিরাপত্তা সুতা, দুটি ল্যাপটপ, দুটি প্রিন্টার, আট ব্যান্ডেল জলছাপ দেওয়া ১০০০ টাকা লেখা কাগজ, দুটি কার্টার ও টাকা তৈরির অন্যান্য সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।

তিনি বলেন, গ্রেপ্তার চক্রের মূল হোতা হাওলাদার সোহেল। ইতোপূর্বে সে দুবার ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। জামিনে বেরিয়ে এসে আবার এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ডিবির উপপুলিশ কমিশনার (ডিবি পশ্চিম) সাজ্জাদুর রহমান জানান, এই চক্রে ১২ জন সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছি। বাকি পলাতক ছয়জনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারব। মো. হাওলাদার সোহেল প্রায় সাত বছর ধরে জাল টাকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সময় সে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরির কারখানা স্থাপন করে বিপুল পরিমাণ টাকা, ভারতীয় রুপি, ডলার, ইউরোসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নোট তৈরি করে দেশব্যাপী বিস্তৃৃত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশে বাজারজাত করে থাকে। তারা ঈদ ও পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে বাজারে যখন টাকার চাহিদা বাড়ে তখন তারাও তৎপর হয়ে ওঠে।

জালনোট চেনার উপায়

সাধারণ মানুষ যাতে সহজে জালনোট শনাক্ত করতে পারে তার জন্য তারা নানা ধরনের সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংক ব্রাঞ্চের ভেতরে ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের ব্যস্ত মোড়ে বড় পর্দায় সন্ধ্যায় এ-সম্পর্কিত ভিডিও দেখানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। কীভাবে জালনোট শনাক্ত করা যায়—এগুলো দেখে মানুষ সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাবে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক জাল নোট শনাক্ত করতে সাধারণ মানুষকে আরো কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছে। যেমন—২০ টাকা এবং তদূর্ধ্ব মূল্যমানের আসল নোটের ওপরের প্রতিচ্ছবি, লেখা মূল্যমান এবং নকশার ওপর হাত বুলালে তা অমসৃণ, খসখসে লাগবে। জালনোটে তেমন বোধ হবে না। ১০ টাকা এবং তদূর্ধ্ব মূল্যমানের নোটের ওপর নিরাপত্তা সুতো সেলাইয়ের মতো ফোঁড়া থাকে। এছাড়া আলোর বিপরীতে ধরলের বাঘের মাথার জলছাপ স্পষ্ট দেখা যায়। জালনোটের সুতা বা জলছাপ এত সূক্ষ্ম থাকে না। আসল নোটে রং পরিবর্তনশীল কালি ব্যবহার করা হয়। ২০০০ সাল থেকে মুদ্রিত ৫০০ টাকার নোটের সম্মুখভাগের ওপরে বাঁ দিকের কোনার অংশ নাড়াচাড়া করলে রং পরিবর্তন হতে থাকে। সবুজ থেকে সোনালি আবার সবুজ হতে থাকে। জালনোটে এই রং পরিবর্তন হয় না। গ্রাহকের কাছে থেকে টাকা নেওয়া এবং দেওয়ার আগে ভালো করে নোটগুলো পরীক্ষা করে নিতে তফসিলি ব্যাংকগুলোকেও নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়া আসন্ন ঈদ উপলক্ষে জালনোটের অপতৎপরতা রোধে রাজধানীর ২৪টি গরুর হাটে ২৪ বুথ বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ২৪ বুথে থাকবে জালনোট শনাক্তকরণ মেশিন। বিক্রি হওয়া গরু ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার আগে টাকাগুলো জাল কি না, তা সহজেই পরীক্ষা করে নিতে পারবেন বিক্রেতা। পাশাপাশি হাটগুলোতে থাকবে র্যাব ও পুলিশের ক্যাম্প। কাউকে সন্দেহ হলে গরুর পাইকাররা সেখানে অভিযোগ করতে পারবেন। জাল টাকা সরবরাহকারী, ছিনতাইকারী, প্রতারকসহ অপরাধীদের বিষয়ে বিশেষ নজর রাখবেন র্যাব ও পুলিশ সদস্যরাও।

Comment here