আন্তর্জাতিকরোহিঙ্গা সমাচার

সীমান্ত নিরাপত্তায় অসংখ্য ছিদ্র, অনুপ্রবেশ চলছেই

এস এম রানা ও জাবেদ ইকবাল, টেকনাফ (কক্সবাজার)

teknaf-pic-23-11-2016

টেকনাফ উপজেলার সঙ্গে নদীপথে মিয়ানমারের ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। নাফ নদের এপারে বাংলাদেশ অংশে কড়া নজরদারি ও পাহারা আছে। তবে সেই নিরাপত্তাব্যবস্থায় অসংখ্য ফাঁকফোকর থাকায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও স্থানীয় প্রশাসন কার্যত অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। যদিও বিজিবি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে সামান্যই। রোহিঙ্গাবোঝাই অনেক নৌকাকে অনুপ্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার ভোরেও তিনটি নৌকাবোঝাই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন ২ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবু জার আল জাহিদ। তিনি বলেন, ‘বিজিবি শুক্রবার ভোরে তিনটি নৌকা ফিরিয়ে দিয়েছে। শুক্রবার দিনের বেলায় অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি।’

তবে লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবু জার আল জাহিদ এমন দাবি করলেও বস্তুত গতকাল ভোররাতেও অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে করেছে। তাদের অনেকের সঙ্গে গতকাল জুমার নামাজের পর কালের কণ্ঠ’র কথা হয়। তারা এখন টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে। অনুপ্রবেশকারী ইলিয়াছ, দুলাই

বেগম, দিলদার বেগম, ফাতেমা খাতুন, মোছাম্মৎ ফাতেমা, সাফায়েত, জাহিদ হোসেন, হামিদ হোসেনসহ অন্যরা জানায়, রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক তাণ্ডব চালাচ্ছে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে।

অনুপ্রবেশকারী কামরুল হোসাইন জানান, মংডুর দক্ষিণ পাশে মেরোংলা এলাকায় গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তিনটি ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে গুলিতে পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছে। এ এলাকায় আগে তাণ্ডব হয়নি। নতুন করে মংডুর দক্ষিণ পাশে তাণ্ডব শুরু করল মিয়ানমার বাহিনী। বেশ কয়েকজনকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা সম্ভব হয়নি। কামরুল হোসাইন কয়েকজন আহত ব্যক্তির ছবি ওপারের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে সংগ্রহ করে কালের কণ্ঠকে হস্তান্তর করেন।

নতুন এলাকায় তাণ্ডব শুরুর খবরে এপারে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে উদ্বেগ আরো বেড়েছে। তাদের ধারণা, মিয়ানমার বাহিনী এত দিন ১৫টি গ্রামে তাণ্ডব চালিয়েছে। এখন রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে নতুন নতুন এলাকা বেছে নেওয়া হচ্ছে।

গতকাল ভোরে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা কালের কণ্ঠকে জানায়, তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। মিয়ানমারে ফিরলে তাদের হত্যা করা হবে। ফাতেমা খাতুন নামের এক নারী জানান, তাঁর ছয় শিশুর মধ্যে দুজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না। বাকি চারজনকে নিয়ে তিনি পালিয়ে আসার জন্য ঘর ছেড়েছিলেন। পথে তাঁর স্বামীকে ধরে গুলি করে মিয়ানমার বাহিনী। শিশুদের সামনেই ওদের বাবার হাত বাঁধা হয় পেছনের দিকে, তারপর গুলি করে তারা। টাকা ও গয়না যা ছিল সব লুট করে নিয়েছে তারা। শেষে তাঁর স্বামীকেও সঙ্গে নিয়ে যায়। স্বামীর ভাগ্যে সর্বশেষ কী ঘটেছে তা তিনি জানেন না। রাতে তিনি নাফ নদের ওপারে এসে অন্যদের সঙ্গে অবস্থান নেন। সেখান থেকে একটি নৌকা তাঁদের তুলে বাংলাদেশে নিয়ে আসে।

গতকাল ভোরে অনুপ্রবেশকারী অন্তত ১৫ জনকে আশ্রয় দিয়েছেন আগে থেকেই লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা কবির আহমদ। তিনি ক্যাম্প এলাকায় মুরগি বিক্রি করেন। কবির আহমদ কালের কণ্ঠকে জানান, ‘অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে একজন পোড়া রোগী ছিলেন। জুমার নামাজের আগে তাঁকে আমার বাসা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। অন্যরা এখনো আছে। আমাদের ঘরের দৈর্ঘ্য ১২ ফুট। সেখানেই সবাইকে গাদাগাদি করে থাকতে হবে, খাবারের ব্যবস্থাও নেই।’ অনুপ্রবেশকারী দুলাই বেগম বলেন, ‘আমাদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, পালিয়ে এই দেশে এসেছি।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাবেক চেয়ারম্যান হাফেজ মোহাম্মদ আইয়ুব জানান, সীমান্ত থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই এ ক্যাম্পের অবস্থান। অনেক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর অনিবন্ধিত ক্যাম্পে আসে। এরপর তাদের অনেকেই আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে এখান থেকে সরে যায়। যাদের আত্মীয়স্বজন নেই তারা আপাতত এখানেই অবস্থান করছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সীমান্ত চৌকি আছে প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার পর পর। প্রতিটি চৌকিতে বিজিবি সদস্যরা সতর্ক পাহারা দিচ্ছেন। কিন্তু এক চৌকি থেকে অন্য চৌকি দেখা যায় না। আঁকাবাঁকা নদীর তীর ধরে গড়ে ওঠা কিছু সড়ক অংশ কিংবা উপকূলীয় প্যারাবন থাকায় দৃষ্টিসীমা খুব বেশি দূরে যায় না। এ ছাড়া উপকূলীয় বন দখল করে নাফ নদের তীরে বেশ কিছু ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছে। এসব কারণে কোথায় কোন সময় রোহিঙ্গাদের নৌকা ভিড়ছে তা বিজিবি সদস্যরা সহজে বুঝতে পারেন না। কোস্ট গার্ড নাফ নদের কিছু অংশে পাহারা দিলেও উজানের দিকে নাব্যতা সংকটের কারণে কোস্ট গার্ডের নৌযানগুলো পাহারা দিতে পারে না। ওই দিকে ছোট নৌকায় সহজেই রোহিঙ্গারা এ দেশে অনুপ্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে।

সীমান্তে দায়িত্ব পালনকারী বিজিবি জওয়ানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা চার-পাঁচজনের দল একেকটি স্থানে পাহারা দেন। কিন্তু নদের তীরে ঘন জঙ্গল কিংবা আঁকাবাঁকা সড়কের কারণে দৃষ্টিসীমা বেশি দূর যায় না। রাতের অন্ধকারে নৌকাগুলোর যাতায়াত বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে।

রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বললেও বিজিবি দায়িত্ব পালন করে মূলত স্থলভাগে। সীমিত পর্যায়ে নৌটহলও দেয় তারা। তাই দেড় থেকে তিন কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদে ফিরিয়ে দেওয়া নৌকা নদের মাঝখানে গিয়ে ফের অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থান দিয়ে যে অনুপ্রবেশ করছে না, সেই নিশ্চয়তা নেই। কারণ বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারগামী নৌকা ওপারে ভিড়তে পারবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি সীমান্ত কড়া পাহারা দিচ্ছে। তাই বিজিবি রোহিঙ্গাদের নৌকা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জানালেও বাস্তবে তা কতটুকু ফেরানো যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

সীমান্তে নিরাপত্তা থাকার পরও রোহিঙ্গারা কিভাবে অনুপ্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে জানতে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেন, ‘সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মিয়ানমার সীমান্তে সড়ক ও কাঁটাতারের বেড়া আছে। আমরা এখনো এ ধরনের অবকাঠামো গড়তে পারিনি। আশা করি ভবিষ্যতে পারব।’ বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘নিরাপত্তা জোরদার করা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু-একজন অনুপ্রবেশ করবে না, এটা বলা যায় না। কারণ এখানে দালাল আছে। দালালরা পয়সার বিনিময়ে লোকজন ঢোকানোর চেষ্টা করছে। এ কারণে আমরা স্থানীয় সরকারের সহযোগিতা চেয়েছি।’ তিনি স্থানীয়দের সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘সহযোগিতা না পেলে বিজিবির সীমাবদ্ধতা থেকেই যাবে। সীমান্তে নদী ও পাহাড়ি পথ দিয়ে লোকজন ঢুকে যাচ্ছে।’

কী পরিমাণ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে, জানতে চাইলে মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেন, ‘বিজিবির কাজ হলো বর্ডার গার্ড করা। এখন কী পরিমাণ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে, সেটা বলা মুশকিল। নিশ্চয় সরকারের অন্য কোনো সংস্থা সার্ভে করে এ চিত্র বের করবে।’

‘অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে’ : গতকাল দুপুরে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন টেকনাফের স্থলবন্দর মালঞ্চ রেস্টহাউস চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করেন। তার আগে গত দুই দিন তিনি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় সীমান্ত ব্যবস্থাপনা প্রত্যক্ষ করেন।

সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনের পর বিজিবি মহাপরিচালক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে সৃষ্ট ঘটনার জের ধরে যাতে কোনো রোহিঙ্গা বা সন্ত্রাসী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে সীমান্তরক্ষী বিজিবি তৎপর রয়েছে। এর পরও কিছু কিছু পয়েন্ট দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ঢুকে পড়েছে। যেসব পয়েন্ট দিয়ে এ ধরনের অনুপ্রবেশ তৎপরতা রয়েছে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেসব পয়েন্টে বিজিবি সদস্য বাড়ানো হয়েছে। তা ছাড়া সীমান্তে উভয় দেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে গত বুধবার বিজিবি-বিজিপির কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। মিয়ানমারে যে অস্থির পরিস্থিতি চলছে তা বিজিপি কর্মকর্তারা বৈঠকে স্বীকার করেছেন। ওপার থেকে যাতে বাংলাদেশে কেউ আসতে না পারে বিজিপিও সে পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘মিয়ানমারে বর্ডারে কাঁটাতারের বেড়া, রাস্তা আছে। কিন্তু আমাদের তা গড়ে তোলা এখনো সম্ভব হয়নি। তাই নিশ্ছিদ্র সীমান্ত ব্যবস্থানা তৈরি করা যায়নি। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিভাবে সীমান্ত সুরক্ষা করা যায়, সেই বিষয়ে কর্মকর্তা ও সৈনিকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়ন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোন্দকার ফরিদ হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সেলিম মাহমুদ চৌধুরী, কক্সবাজার সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল এম এম আনিসুর রহমান, লে. কর্নেল মো. আবু জার আল জাহিদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Comment here