আন্তর্জাতিকরোহিঙ্গা সমাচার

২৫ আগস্ট কালো দিবস বা গণহত্যা স্বরণ দিবস পালন করেছে রোহিঙ্গারা : পূর্ণ নাগরিকত্ব নিয়ে নিজ দেশে ফেরার আকুতি

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী:
পূর্ণ নাগরিকত্ব নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাবার আকুতি নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার বর্ষপূর্তি পালন করেছে রোহিঙ্গারা। উখিয়া-টেকনাফের ৩০ রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির ছাড়াও নো ম্যান্স ল্যান্ড এ ২৫ আগস্ট কে কেউ কালো দিবস আবার কেউ গনহত্যা স্বরন দিবস পালন করেছে। দিনটিকে স্বরণ করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে মিছিল, সমাবেশ ও দোয়া পাঠ পালন করেছে। জানা যায়, ২৫ আগষ্ট কে “কালো দিবস” ঘোষনা করেছে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংঘঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি (এআরএস)। এ দিবসটি পালনের জন্য তারা কর্মসূচীও ঘোষনা করেছে। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সকাল ৯ টায় কর্মসূচী শুরু হয়। এরপর মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর বর্বরতা ও গণহত্যা সম্পর্কে আলোচনা, আইনী অধিকার সম্পর্কিত বত্তব্যসহ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ দুপুর সাড়ে ১২ টার সময় রোহিঙ্গা সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে দিবসটির সমাপ্তি হয়। সকাল থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে মিছিল সহকারে ক্যাম্পের বিভিন্ন খোলা মাঠে জড়ো হতে থাকে। কারো হাতে মিয়ানমারের মানচিত্র খচিত কাগজের পতাকা, কারো মাথায় লাল কাপড়ের ব্যান্ড, কারো হাতে ব্যানার ছিলো। ছাত্ররা স্কুল ড্রেস পড়েও জমায়েত হয়। এসব কর্মসুচীতে রোহিঙ্গা দ্রুত সময়ে মিয়ানমারের র্পূণ নাগরিকতা নিয়ে ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। তারা এ ক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায়ের জোড়ালো সমর্থন আশা করছেন। রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আন্তরিক কৃজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের জনগন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার রোহিঙ্গাদের আ¤্রয় দিয়ে করেছে তা নজিরবিহীন।
এআরএস মুখপাত্র মো: মুহিব উল্লাহ জানিয়েছেন, আমরা পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। তাই ২৫ আগস্টকে কালো দিবস পালন করে মিয়ানমারের সরকারী বাহিনীর গনহত্যার ঘটনা বিশ্ববাসীকে স্বরণ করিয়ে দিতে চাই। মিয়ানমার সরকার জালেম সরকার। তারা মানবিকতা কি তা জানে না । তারা জানে শুধু মানুষ হত্যা। তিনি জানান ,
উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, টাইংখালী, ক্যাম্প ১৭, ৫, ৭, ২ ও ১ , জামতলী, টেকনাফের লেদা, শালবাগান ও নো-ম্যান্স ল্যান্ড রোহিঙ্গা শিবিরে একই সময়ে ২৫ আগস্ট কালো দিবসের কর্মসুচী স্বর্তস্ফুতভাবে পালিত হয়েছে। অপর দিকে “দা ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন” নামের একটি সংগঠন ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা জেনোসাইড স্বরণ দিবস পালনের ঘোষনা দিয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরে সংগঠনটি বাংলা, ইংরেজী ও বার্মিজ ভাষায় লিফলেট বিতরণ করেছে। গত ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের ৩০ সরকারী সামরিক স্থাপনায় হামলার অভিযোগে মিয়ানমার সরকারী বাহিনী রোহিঙ্গা জাতিঘোষ্ঠীর উপর বর্বর হামলা চালায়। মিযানমার সরকার এ ঘটনার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) বা আল-ইয়াকিন নামক রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনকে দায়ী করে।
এরপর পরই মিয়ানমার সেনা বাহিনী, পুলিশ ও উগ্র বৌদ্ধরা মুসলিম বসতির উপর আক্রমন শুরু করে। নারী ধর্ষণ, ঘরবাড়ীতে আগুন, লুটরাজ, মসজিদ মাদ্রাসা আগুন ধরিয়ে দেয়। হত্যা করে শিশু থেকে বৃদ্ধকে। ধর্মীয় নেতাদেও পুড়িয়ে মারে । শত শত যুবককে আটক করে গণকবর দেওয়ারও অভিযোগ করে রোহিঙ্গারা। গণহত্যার মত অপরাধ , নারী ও শিশু ধর্ষণ ইত্যাদি হতে বাচঁতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আ¤্রয় নেয়। টেকনাফ- উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে পাহাড়ী পথ, নাফনদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। গত এক বছরের ৭ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা ২৫ আগষ্টের পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর অপর একটি হামলার ঘটনার জের ধরে মিয়ানমার সেনা বাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। এর আগে ১৯৯১ সালে আরেক দফায় আড়াই লাখেরও বেশী সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশে চলে আসলেও পরের বছর থেকে এদের মিয়ানমার ফেরত নেওয়া শুরু করায় প্রায় ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা স্বদেশে ফেরত যায়। তখন থেকে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়া পাড়াতে প্রায় ২৪ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা রয়ে যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সর্বশেষ সেনা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের যে রেজিষ্ট্রেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো সেখানে নতুন পুরাতন মিলে প্রায় সোয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গা তালিকাভূক্ত হয়। রোহিঙ্গাদেও প্রত্যাবাসন নিয়ে গেলো বছর নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ও গেলো জুন মাসের দিকে মিয়ানমার ইউএন চুক্তিবদ্ধ হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সম্প্রতি বাংরাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে একটি টিম আরাকান সফর করে আসেন। এ টিমের সদস্য বাংরাদেশ সরকারের ত্রাণ ও শরনার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন, একটি ট্রানজিট জেটি ও ২ টি ট্রানজিট হাউস ছাড়া এখনো কিছুই তৈরী করেনি মিয়ানমার। রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে তাদের নিজস্ব বাড়ী ঘরে ফিরে যেতে পারে সেই পরিবেশ সেখানে এখনো গড়ে উঠে নি। অপর দিকে মিয়ারমারের ষ্টেট কাউন্সিলার অং সান সুচি সিঙ্গাপুরে একটি আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে বলেছেন মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেও ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোগের অভাবের কারনে তা হচ্ছে না। গত বছর আরসার হামলার জবাবে সেনাবাহিনী যে অভিযান চালায় তাতে আরাকানিজ, থেট এবং ডাইংনেট সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষ পালাতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের হিসাব মতে, প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়।

Comment here