আন্তর্জাতিকউখিয়াটেকনাফরোহিঙ্গা সমাচার

২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের চার বছর : প্রতিবছর ৩৫ হাজার গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারী : থমকে আছে প্রত্যাবাসন : বাংলাদেশ পাঠিয়েছে ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ জনের তালিকা : মিয়ানমার ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে মাত্র ২৭ হাজার ৬৬৯ জন

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, কক্সবাজার :
২৫ আগস্ট নতুন করে রোহিঙ্গা আগমের চার বছর পূর্ণ হলো। রোহিঙ্গারা দিনটিকে “জেনোসাইড রিমেম্বার ডে” বা গণহত্যা দিবস ইত্যাদি নামে পালন করে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন স্হানে থাকা রোহিঙ্গারা দিনটিকে বিভিন্ন ভাবে স্বরণ করে তাদের আবাস ভূমি মিয়ানমারের রাখাইনে পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে ফেরার দাবী করে তাকে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যান্তরে দিনটিকে ঘিরে কোন কর্মসূচির পালনের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন শরনার্থীর ত্রাণ ও পূর্নবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত।

২০১৭ সালের এই দিনে মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম সেখানের সরকারি বাহিনীর ধর্ষণ, গণহত্যা, নির্যাতন ও প্রাণভয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে পালিয়ে আসে।
মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার এসব মিয়ানমার নাগরিকদের (হিন্দু ও রোহিঙ্গা মুসলিম) আশ্রয় দেয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দু হাজার একর ভূমিতে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যেোগ নেয় সরকার। আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে সাড়ে ছয় হাজার একর অর্থাৎ প্রায় ২৬ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় নতুন ৩২ টি জোর পূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক (এফডিএমএন) ক্যাম্প স্হাপন করা হয়েছে।
কক্সবাজারে অবস্থিত
শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) গত ১১ আগস্টের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ লাখ ৫২ হাজার ৭০১ জন আশ্রয় প্রার্থী প্রবেশ করেছে। এর আগে ১৯৯১-৯২ সালে আসা ও পরবর্তীতে ফিরতে না পারা ৩৫ হাজার ৬৮০ জন রোহিঙ্গা মুসলিম উখিয়া কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত ক্যাম্পে শরনার্থী হিসেবে ছিল। বর্তমানে কক্সবাজারে ৩৪ টি ও নোয়াখালীর ভাসান চরের ১ টি সহ মোট ৩৫ টি ক্যাম্পে এরা অবস্থান করছে।
আশ্রয় নেয়া এসব মিয়ানমার নাগরিকদের খাদ্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হয়ে থাকে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফও) ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৯৩৭ জনকে এ সহায়তার আওতায় এনেছে।
এর মধ্যে জেনারেল ফুড ডিস্ট্রিবিউশন (জিএফডি) পদ্ধতিতে ১৩ হাজার ৬৫০ জনকে
প্রতিমাসে জনপ্রতি ১২ কেজি চাল, ৪ কেজি ডাল ও ১ লিটার তেল ও ই- ভাউচার পদ্ধতিতে ৮ লাখ ৪৪ হাজার ২৮৭ জনকে ২১ টি আউটলেট হতে জনপ্রতি ৯২৯ দশমিক ০৭ টাকা মূল্যের ভাউচার ও ১ কেজি ডাল দ্রব্য ভাউচার হিসেবে সরবরাহ করা হয়। ই – ভাউচার পদ্ধতি খাদ্য সামগ্রী বিতরণ হার ৯৯ শতাংশ।
এ ছাড়া অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩০ শতাংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সতেজ খাবার ক্রয়ের জন্য অতিরিক্ত ২৫৩ দশমিক ৩৮ টাকা সরবরাহ করেছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা।

আশ্রয় নেয়া এসব মিয়ানমার নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে সরকার ও জাতি সংঘ শরনার্থী সংস্থা ( ইউএনএইচসিআর) সম্মত যৌথ ভেরিফিকেশন ফর্ম অনুযায়ী গত ২০১৮ সালের ২৪ জুন তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করে। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছরে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৩ পরিবারের ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৭০৪ সদস্যের রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯১ জন নারী ও ৪ লাখ ৩০ হাজার ৯১৩ পুরুষ।
এসব রেজিষ্ট্রেশন করা তালিকা থেকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ২২৮ পরিবারের ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ জনের
নাম ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে মিয়ানমার ওই তালিকা থেকে মাত্র ২৭ হাজার ৬৬৯ জনের ক্লিয়ারেন্স পাঠিয়ে।ইতিমধ্যে টেকনাফের কেরনতলী ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে দু” টি প্রত্যাবাসন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। কেরনতলীতে রয়েছে একটি প্রত্যাবাসন ঘাটও। এ ছাড়া আরো দুটি প্রত্যাবাসন কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তুতি চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করলেও মিয়ানমারের অসহযোগিতা ও আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার প্রাপ্তির দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার তাদের অনিহার কারণে থমকে যায়। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারী মাসে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে বিজয়ী অং সান সুচির এনএলডি পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। ফলে রোহিঙ্গা সংকট আরো বিলম্বিত হয়।

এ বিষয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইট্স প্রধান মহিব উল্লাহ বলেন, ” পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে আমরা মিয়ানমারের ফিরতে চাই। ”

প্রতিবছর ৩৫ হাজার গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারী

এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় নানাবিধ সংকট তৈরি হচ্ছে দু দেশের মধ্যে। ক্যাম্পে প্রতিবছরে গর্ভবতী হচ্ছে ৩৫ হাজার নারী। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) সহযোগিতায় পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে চলতি (২০২১ সাল) বছরের শুরুতে জরিপ কার্যক্রম চালায়। এতে ইউএনএইচসিআর এর পপুলেশন সীট অনুযায়ী ৩৫ হাজার ৪ জন ও হেল্থ সেক্টরের তথ্য অনুযায়ী ৩৫ হাজার নারী প্রতিবছরে গর্ভবতী হচ্ছে। এসব গর্ভবতী নারীর জন্ম দেওয়া শিশু সন্তান গুলোর তালিকা নিয়েও বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন সংকট দেখা দিতে পারে এমন মত প্রকাশ করেছেন কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধান করা জরুরি। যে হারে ক্যাম্পে জন সংখ্যার বাড়ছে। তা বিস্ফোরক আকার ধারণ করতে পারে কক্সবাজারের। ”
কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ পরিচালক ডাক্তার পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য জানান, ” রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থায়ী ও স্বল্প মেয়াদি জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এখন অনেকে বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। ” তবে এখানে কোন টার্গেট নির্দিষ্ট করা হয় না বলে জানান তিনি।

Comment here