এক্সক্লুসিভ

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন : ভয়াবহ পরিবেশ ঝুঁকি : জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন : ভয়াবহ পরিবেশ ঝুঁকি :

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, টেকনাফ :

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
পর্যটন মৌসুমে দ্বীপে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকদের যাতায়াত, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশ দূষণ, পর্যটকদের অসচেতনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সেখানকার ইকো-সিস্টেম অর্থাৎ প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে দ্বীপ রক্ষায় কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দ্বীপের পরিবেশ ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে জানান স্হানীয় চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, “পরিকল্পিত পরিকল্পনার অভাব ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতার
কারণে দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এবং জীব-বৈচিত্র্য এখন বিলুপ্ত হবার পথে।”

সেন্ট মার্টিনে যেকোনো ধরণের স্থাপনা গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করেই গড়ে উঠছে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল।

এছাড়া পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যত্রতত্র প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা, ভারী জেনারেটর, পাম্প পরিচালনা, পাথর তোলা, সৈকতের বালি অপসারণ, এক কথায় পরিবেশ বিধ্বংসী সব ধরণের কাজই হচ্ছে দ্বীপটিতে।

পরিবেশ অধিদফতর জানিয়েছে, অবৈধভাবে গড়ে উঠা সেন্টমার্টিনের এসব স্থাপনা উচ্ছেদে তারা কয়েক দফা অভিযানে গিয়ে দেখেছে যে বেশিরভাগই আদালতের থেকে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়ে পরিচালনা করছে।

এ কারণে অধিদফতরও কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না।

অথচ জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে সরকার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা-ইসিএ ঘোষণা করেছিল।

পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রতিদিন যদি পর্যটকদের সংখ্যা সীমিত করে ১০০০ বা ১২০০ জনের মধ্যে রাখা যায়, তাহলেও কিছুটা ভারসাম্য রাখা সম্ভব হবে।

কিন্তু সেখানে প্রতিদিন কমপক্ষে আট থেকে দশ হাজার পর্যটক ভিড় করছে।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার অফিসের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম
বলেন, ” পর্যটন মৌসুম অক্টোবর থেকে শুরু হবে। তখন থেকে একজন নির্বাহী ম্যাজেস্ট্র্যাট এর সেন্টমার্টিনে নিয়মিত অবস্থান করবে এবং পরিবেশ রক্ষায় সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করবে।”

পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা এই দ্বীপটির স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। এছাড়া পর্যটক মিলে প্রতিদিন দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষের চাপ নিয়ে এক প্রকার মৃতপ্রায় অবস্থা সেন্টমার্টিনের।

অতিদ্রুত পর্যটকদের স্রোত ঠেকানো না গেলে এই দ্বীপের পরিবেশে ভারসাম্য ফেরানো রীতিমত অসম্ভব হবে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

সেন্টমার্টিনের জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে দ্বীপটি যে কোন সময়ে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তারা বলছে মানুষের কোলাহল এবং সৈকত ও পানিতে অতিরিক্ত দূষণের কারণে দ্বীপের বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে সামুদ্রিক কাছিম।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার অফিসের উপ- পরিচালক মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন,
“এখানে আসলে সবার চেষ্টা লাগবে। একা পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষে সব করা সম্ভব না। সবকিছুর এখতিয়ারও আমাদের নেই। পর্যটকদের সচেতন হওয়াও জরুরি।”

১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে পরিবেশ অধিদফতর

এমন অবস্থায় সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১৪টি বিধিনিষেধ দিয়ে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গত কয়েক মাসে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে পরিবেশ অধিদফতর।

দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বিরল জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারসহ দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী দ্বীপে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

সেগুলো হল:

দ্বীপের সৈকত, সমুদ্র বা নাফ নদীতে সব ধরণের প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা।

পশ্চিম পাশের সৈকতে কোনাপাড়ার পর দক্ষিণ দিকে এবং পূর্ব পাশের সৈকতে গলাচিপার পর দক্ষিণ দিকে পরিভ্রমণ।

দ্বীপের সৈকতে মোটরসাইকেলের মতো যান্ত্রিক বাহন থেকে শুরু করে সাইকেল, ভ্যান, রিকশার মতো অযান্ত্রিক বাহনের চালানো।

দ্বীপের চারপাশে নৌ ভ্রমণ করা।

জোয়ার ভাটা এলাকায় পাথরের ওপর হাঁটা চলা।

সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার স্থানে চলাফেরা, সৈকতে রাতে আলো জ্বালানো এবং ফ্ল্যাশ লাইট ব্যবহার করে ছবি তোলা।

সৈকতে রাতের বেলা কোন প্রকাশ আলো বা আগুন জ্বালানো, আতশবাজি ও ফানুশ ওড়ানো।

সৈকতে মাইক বাজানো, হৈ-চৈ বা উচ্চস্বরে গান বাজনা করা, বার-বি-কিউ পার্টি করা।

ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে স্পিডবোট, কান্ট্রি বোট, ট্রলার বা অন্যান্য জলযানে যাতায়াত এবং নোঙর করা।

সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণকৃত ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ ভ্রমণ।

প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, তারা মাছ, রাজ কাঁকড়া, সামুদ্রিক ঘাস, সামুদ্রিক শৈবাল এবং কেয়া ফল সংগ্রহ ও ক্রয় বিক্রয়।

জাহাজ থেকে পাখিকে চিপস ও অন্য খাবার খাওয়ানো।

দ্বীপে ভুগর্ভস্থ সুপেয় পানি সীমিত বিধায়, পানির অপচয় করা।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর যেকোন কার্যক্রম গ্রহণ করা।

শুধু আইন প্রয়োগ নয় বরং পর্যটকদের সচেতন করে তুলতে এ ধরণের প্রচারণাকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর।
এ বিষয়ে চলতি মৌসুমে কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) এরফানুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ” দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক রক্ষায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কাজ করছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্হানীয় প্রশাসন কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ”

একটা সময় পর্যন্ত পর্যটন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার’ দাবি——

তবে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই দ্বীপে পর্যটকদের চলাচল পুরোপুরি বন্ধ না করলে দ্বীপের পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না। এমন দাবীর কথা বলেছেন টেকনাফ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ছৈয়দ হোছাইন। তিনি বলেন, “এই সময়ের মধ্যে সৈকত ও পানির নীচে যতো দূষণ হয়েছে সব পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়া দ্বীপের সব ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে হবে।”

বছরের একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে শুধুমাত্র দিনের বেলা সীমিত সংখ্যক পর্যটকদের যাতায়াত করতে দেয়া হলে দ্বীপটির পরিবেশের ভারসাম্য ও জীব-বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা যাবে।

এ কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে।

এ নিয়ে কয়েক দফা সেন্টমার্টিন দ্বীপ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হলেও একবারও তা কার্যকর হয়নি।

এছাড়া সেন্টমার্টিনের দক্ষিণেই ছেঁড়াদিয়া দ্বীপও রয়েছে পরিবেশগত হুমকির মুখে। এ কারণে সরকারি ওই বিজ্ঞপ্তিতে ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে কোন জলযানে যাতায়াত নিষেধ করা হয়েছে।

এই দ্বীপে রাতে থাকা না গেলেও কাঠের নৌকা এবং স্পিডবোটে করে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক সেদিকেও ছুটে যাচ্ছেন এবং পরিবেশ নোংরা করছেন।

এ কারণে দ্বীপটিতে এখনও যে কয়টা জীবিত প্রবাল টিকে আছে, সেগুলো ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে

এমন অবস্থায় দ্বীপটির জীবিত প্রবাল বা সামুদ্রিক জীব টিকিয়ে রাখতে একটি কর্ম পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।

Comment here