আন্তর্জাতিকএক্সক্লুসিভ

রাখাইন ফ্রন্ট লাইনে যেভাবে যুদ্ধ চলছে : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবঃ)

রাখাইন ফ্রন্ট লাইনে যেভাবে যুদ্ধ চলছে
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবঃ)

——-
মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (তৎকালীন লুনটিন বাহিনী) সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল অংজিকে গাড়িতে নিয়ে ঘুমধুম সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারের ভুখন্ডে প্রবেশ করলাম…। এটি ছিল, ২০০৮ সালের ২৯ জুন এর ঘটনা। তখন আমি টেকনাফে নিয়োজিত একটি বিডিআর ব্যাটালিয়নের (বর্তমানে বিজিবি) ‘‘ব্যাটালিয়ন কমান্ডার’’ হিসেবে কর্মরত। কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সেক্টর পর্যায়ের মিটিং শেষে মিয়ানমারের তৎকালীন লুনটিন বাহিনীর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপি) প্রতিনিধি দলকে ঘুমধুম সীমান্তের ‘ফ্রেন্ডশীপ ব্রীজ’ পেরিয়ে মিয়ানমারের‘ ঢাকিবুনিয়া ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছিলাম।

এর প্রায় ১৬ বছর পর, আরাকান আর্মির (এএ) প্রচন্ড আক্রমনের মুখে ২০২৪ সালের ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারী সময়কালে প্রায় এই অঞ্চল দিয়ে ৩৩০ জন সীমান্তরক্ষী/সৈনিক/কাষ্টম অফিসিয়াল পালিয়ে বাংলাদেশে এসে প্রাণ বাঁচালেন। পরবর্তীতৈ ১১ মার্চ তারিখে বিজিপির আরো ১৭৯ জন সদস্য নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই বিস্ময়কর ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা জানান দেয়, রাখাইন স্টেট বা রাজ্যে (পূর্বতন আরাকান) আরাকান আর্মি ও সামরিক বাহিনীর (তাতমাদো) মধ্যকার লড়াইয়ের তীব্রতা।

রাখাইনে এখন সামরিক-জান্তার বাঁচা-মরার লড়াই চলছে। মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রেজ বলেছেন- ‘‘মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন সামরিক-জান্তা ইতিমধ্যে ‘‘অস্তিত্বগত হুমকির’’ সম্মুখিন হয়েছে’’। উল্লেখ্য, রাখাইন ফ্রন্ট লাইনে তাতমাদোর সঙ্গে যুদ্ধ করছে আরাকান আর্মি। অন্যদিকে ক্ষুধার সঙ্গে অন্যরকম এক যুদ্ধ সংগ্রামে জীবন কাটাচ্ছে সাধারণ রাখাইনবাসী।

২০২৩ এর ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ পরিচালিত ‘অপারেশন ১০২৭’ রাখাইনের প্রায় ৩৬ হাজার বর্গমাইল ব্যাপী রণাঙ্গনে আরাকান আর্মির যুদ্ধ ও সংগ্রামকে নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করেছে। এএ রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী ম্রাউক-উসহ ৯ টি শহর দখল করে করেছে। দলটি রাজ্যের প্রায় ৭০% অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের দাবী করছে। রাখাইন রাজ্যটি জান্তা সরকারের (স্টেট এডমিনিসট্রেশন কাউন্সিল) প্রায় হাতছাড়া হতে চলেছে। রাখাইনে জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শহর-কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ইনসারজেন্সি থেকে মিয়ানমারের সংঘাত এখন তীব্র গৃহযুদ্ধে পরিনত হয়েছে। গৃহযুদ্ধের সেন্টার অব গ্র্যাভিটি বা ভরকেন্দ্র এখন রাখাইন। নাফ নদীর ওপারে রাখাইনের নতুন শেরিফ এখন আরাকান আর্মি।

প্রায় ৭৫ বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে (তাতমাদো) ‘‘অজেয় বাহিনী’’ হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু গত ৪ মাসে ৮ টি ফ্রন্টে বিশেষত সাগাইং, কারেন, মান্দালয়, ম্যাগওয়ে, তানিনথারি, শান, চিন, মন ও আরাকানের অরন্যময় রণাঙ্গনে ইতোমধ্যে তাতমাদোর কয়েক হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। তাতমোদোকে এখন কেউ কেউ ‘‘হোয়াইট ফ্ল্যাগ আর্মি’’ (আত্মসমর্পণকারী সেনাবাহিনী) বলেও অভিহিত করছে। আমাদের পাশ্ববর্তী এই দেশটিতে সংঘঠিত গৃহযুদ্ধ বিশেষত রাখাইন রণাঙ্গনের বিশদ বিবরণ জানা প্রয়োজন। এই বিবরণ রাখাইনে চলমান সংঘাত ও এই অঞ্চলে পরবর্তী অবস্থা বা ঘটনাবলী বুঝতে সাহায্য করতে পারে।

আন শহরের তাতমাদো কমান্ড পোষ্টে আতঙ্ক
মধ্য রাখাইনের আন শহরে মিয়ানমার বাহিনীর ‘‘ওয়েস্টার্ন কমান্ড’’ (রিজিওনাল মিলিটারি কমান্ড-আরএমসি) এর সদরদপ্তর অবস্থিত। ২০২০ সাল থেকে মেজর জেনারেল থিন লাট ও এই কমান্ডের অধিনায়ক হিসেবে কাজ করছেন। যার দায়িত্বে রয়েছে সমগ্র রাখাইন রাজ্যের সামরিক বিষয়সমূহ।

২০২২ এর আগষ্ট থেকে এএ নিয়ে জেনারেল থিন লাট এর প্রচন্ড মাথা ব্যাথা। তখনই যুদ্ধ-বিরতি ভেঙে এএ এর সঙ্গে তাতমাদোর প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। ‘‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’’ এর ‘‘অপারেশন ১০২৭’’ শুরু (অক্টোবর ২০২৩) হওয়ার পর থেকে রাখাইন আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। ১৩ নভেম্বর থেকে আরাকান আর্মি উত্তর রাখাইনে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করে।

গত ৪ মাসে রাখাইনে ৯ টি শহরের পতন হয়েছে। শত শত সৈন্য আরাকান আর্মির কাছে আত্মসমর্পন করেছে। প্রায় ৭০০ সীমান্ত রক্ষী/সৈনিক ভারত ও বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এএ এর আক্রমনে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতমাদো। নিজের সুরক্ষিত কমান্ড পোস্টে ব্যাস্ত সময় কাটছে জেনারেল থিন লাট ও এর। সামনে রাখাইনের বিশাল অপারেশনাল ম্যাপ। এই ম্যাপে লাল রঙ দিয়ে এএ এর মোতায়েন (ডেপলয়মেন্ট) ও আক্রমনের কার্যক্রম দেখানো হয়েছে। ম্যাপের দিকে তাকিয়ে জেনারেলের মনে হচ্ছে আরাকান আর্মি যেন তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে।

২০২২ সালের মে মাসে আরাকান আর্মি প্রধান মেজর জেনারেল ‘‘তোয়াং ম্রা নায়েঙ’’ তাতমাদোর ‘‘ওয়েস্টার্ন কমান্ডের’’ প্রধানকে ‘‘টুইটারে’’ মারাত্মক এক হুমকি দিয়েছিলেন। তখন রাখাইনে দুই পক্ষের যুদ্ধ বিরতি চলছিল। এএ প্রধান টুইট করেছিলেন…. ’’ Htin Latt oo, Do not go too far ……… I will come to your place and crush it’’ ‘‘থিন লাট ও, তুমি বেশী বাড়া বাড়ি করোনা। তুমি কিন্তু আমাকে খুব বিরক্ত করছো। আমি একদিন তোমার জায়গায় যাব ও তোমাকে ধ্বংস করবো’’।

এএ এর আক্রমনে উত্তর ও মধ্য রাখাইনের পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। দক্ষিণ রাখাইনেও রামরি শহরের পতন হয়েছে। জান্তা-প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাই নিজেই যুদ্ধের খোজঁ খবর নিচ্ছেন। অপারেশনের ব্যর্থতার জন্য তাকে ভৎসনাও করেছেন। অন্যদিকে সিথওয়ে এলাকার অপারেশন নিয়ে সেখানকার ‘‘রিজিওনাল অপারেশন কমান্ড’’ (আরওসি) এর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিও মিন লাট এর সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়েছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে এই ‘আঞ্চলিক কমান্ডার’ প্রচন্ড চাপের মুখে আছে। এই পরিস্থিতিতে, প্রায় ২ বছর পূর্বে আরাকান আর্মি প্রধানের হুমকিটা এখন চরম আতংকে পরিনত হয়েছে। এএ প্রধানের হুমকি কি সত্যিই বাস্তব হতে যাচ্ছে? ‘‘থিন লাট ও-আই উইল কাম এন্ড ক্রাশ ইউ ‘’!

আরাকান বা রাখাইন রাজ্য- সংবাদ
মিয়ানমারের ম্যাপের দিকে তাকালে একে অনেকটা ঘুড়ির মতো দেখায়। এই ঘুড়ির পশ্চিম দিকে রাখাইন স্টেট বা রাজ্যটি অবস্থিত। রাখাইন বঙ্গোপসাগরের উপকুল বরাবর অনেকটা উত্তর দক্ষিণে আড়াআড়ি এক ভূখন্ড। রাখাইন রাজ্যের পূর্বতন নাম আরাকান। মিয়ানমারের পশ্চিম উপকুলে অবস্থিত আরাকান রাজ্যের আয়তন ৩৬,৭৬২ বর্গ কিলোমিটার। রাজধানী শহরের নাম সিথত্তয়ে (পূর্বতন আকিয়াব)। ৪ জেলা, ১৭ টি টাউনশিপ আর ১০৪১ টি গ্রাম রয়েছে এ রাজ্যে।

এর উত্তর অংশ প্রায় ১০০ মাইল চওড়া, ক্রমে এটা সরু হয়ে দক্ষিণে বিশ মাইলের মতো প্রশস্ত। রাখাইন পাহাড়ি অঞ্চল, গভীর বনভূমি, নদী এবং খাড়ি অঞ্চল নিয়ে গঠিত। রাখাইনের উত্তর পশ্চিমে বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৬ কিলোমিটার জুড়ে স্থল ও জল সীমান্ত (কক্সবাজার ও বান্দরবান) রয়েছে। রাখাইনের উত্তরে “চিন রাজ্য”। এর পূর্বে সুউচ্চ ও দুর্গম ‘‘আরাকান ইয়োমা’’ পর্বতমালা যা রাখাইনকে মূল বার্মা থেকে পৃথক করে রেখেছে। পূর্বে মিয়ানমারের ম্যাগওয়ে, বাগো এবং আয়োইয়ারওয়াদি রিজিয়ন বা অঞ্চল। এর পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে ৩৬০ মাইল বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা। রাখাইনের প্রধান প্রধান নদী হলো কালাদান, মাইয়ু, এবং লেমব্র। রাখাইনের ৭০% এলাকা বনাঞ্চল। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চল ‘‘ধান্যাবাদি’’ (ধান ভান্ডার) হিসেবে পরিচিত ছিল। কৃষি-প্রধান ও অত্যন্ত অনুন্নত রাজ্য রাখাইনের উপকূল অঞ্চলে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ। রাখাইনের অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য রাখাইনের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব বর্তমানে অসাধারণ।

রাখাইনের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। রাখাইনের প্রধান জাতি গোষ্ঠি রাখাইন (সংখ্যাগরিষ্ঠ) ও রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা মূলত ইসলাম আর রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। দক্ষিণ রাখাইনে বামার জনগোষ্ঠির বসবাস রয়েছে। এছাড়াও চিন, কামান, ম্রো, দৈনাক, থেট, খুমি, চাকমা, মারামাগ্রিসহ বেশকিছু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি রয়েছে। এই রাজ্যে রাখাইন জনগোষ্ঠির সংখ্যা প্রায় ৩২ লক্ষ। রাখাইনে বর্তমানে প্রায় সোয়া ৬ লক্ষ রোহিঙ্গা রয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির (জোরপূর্বক বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যূত) প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে।

রাখাইন অঞ্চলের সামরিক ও কৌশলগত গুরুত্ব
অত্যন্ত দারিদ্র-পীড়িত রাখাইন এলাকাকে সামরিক বিবেচনায় এক সময় প্রায় ‘‘নিশ্চল সামরিক অঞ্চল’’ (মিলিটারি ব্যাকওয়াটার) বিবেচনা করা হতো। পশ্চিম দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত এলাকাকে তাতমাদো কর্তৃপক্ষ ‘‘পশ্চিমের দ্বার’’ বা ‘‘ওয়েস্টার্ন ডোর’’ বলে অভিহিত করে থাকে। রাখাইন এলাকায় তাতমাদো মাঝেমধ্যে দুর্বল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করতো।

তবে ২০১০-দশকের মধ্যভাগ থেকে রাখাইনে তাতমাদোর সামরিক শক্তির ব্যাপক পরিবর্তন হয়। বিশেষত ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে পরিচালিত নিষ্ঠুর গণহত্যামূলক সামরিক অভিযান (ক্লিয়ারেন্স অপারেশন) পরিচালনার সময় থেকে এ অঞ্চলে ব্যাপক সেনা মোতায়েন (সামরিককরণ) করা হয়। একই সঙ্গে রাখাইনের গ্যাস ক্ষেত্রের উন্নয়ন, বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্র সীমা বিষয়ক বিরোধের প্রেক্ষিতে নৌ শক্তি বৃদ্ধি, চকপিউতে গভীর সমুদ্র বন্দর, স্পেশাল ইকোনমিক জোন তৈরী, সর্বোপরি চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর- এসব বিষয়সমূহ রাখাইনের কৌশলগত ও সামরিক গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে তোলে।

আরাকান আর্মি’র সাত কাহন
এই মূহুর্তে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আলোচিত গেরিলা দল হলো আরাকান আর্মি। বামার আধিপত্যপূর্ণ জান্তা-সরকারের শোষন বঞ্চনার প্রতিবাদে পূর্ণ স্বাধীনতার আশায়, ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মাত্র ২৬ জন আরাকানি তরুন সহযোগীদের নিয়ে ট্যুর গাইডের জীবন ছেড়ে মেজর জেনারেল তোয়াং ম্রা নায়েঙ ‘‘আরাকান আর্মি’’ প্রতিষ্ঠা করেন। কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মির সহায়তায় কাচিন রাজ্যের লাইজায় এই গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়। এর পর তাদের সঙ্গে যোগ দিতে থাকে পাথর খনিতে কর্মরত অভিবাসী রাখাইন শ্রমিকরা। সেই থেকেই তাদের বিদ্রোহ শুরু। ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে সংগঠনটি। রাখাইন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাদের জনপ্রিয়তা।

৪৬ বছর বয়সী ক্যারিসমেটিক নেতা (স্বঘোষিত) মেজর জেনারেল তোয়াং ম্রা নায়েঙ বর্তমানে থাকছেন চীন সীমান্তের কাছে শান রাজ্যের পাঙসাঙয়ে। যাকে এএ এর অর্থনৈতিক সদরদপ্তর মনে করা হয়। এএ এর রাজনৈতিক শাখা ‘‘ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান’’ (ইউএলএ) এর নেতৃত্বেও রয়েছেন মেজর জেনারেল নায়েঙ। আরাকান আর্মির সদরদপ্তর হলো কাচিন রাজ্যের লাইজায়। এখানে অবস্থান করেন আরাকান আর্মির ভাইস ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ নিও টোয়ান আং। অন্যদিকে এএ এর একটি ফাংশনাল হেডকোয়ার্টার চিন রাজ্যের পালেটওয়েতে। এমন অদ্ভুত নেতৃত্ব- অবস্থায়ও জেনারেল নায়েঙ এর গেরিলা-সৈনিকরা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইনে তাতমাদোর বিরুদ্ধে লড়ছে প্রচন্ডভাবে।

২০১৪ সালে এএ- ‘আরাকান ড্রিম ২০২০’ নামে একটি রাজনৈতিক রোড ম্যাপ প্রকাশ করে। এই রোড ম্যাপ প্রকাশের পর থেকে এএ এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। মাত্র এক দশকের মধ্যে গোষ্ঠিটি মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী, সুসংগঠিত ও কার্যকর জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এর রাজনৈতিক শাখা ‘‘ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান’’ ও সফলভাবে তাদের প্রচার চালিয়ে যায়। বিশেষত ২০২০-২০২৩ সালের যুদ্ধ-বিরতি সময়কালে রাখাইনের গ্রামাঞ্চলে (টাউনশিপ এলাকায়) এএ একধরনের সমান্তরাল ছায়া প্রশাসন চালু করতে সক্ষম হয়। প্রশাসনিক এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সশস্ত্র শাখা নতুন সদস্যদের ভর্তি ও প্রশিক্ষণ শুরু করে।

১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। এই সালে বার্মিজ মান্দালয় রাজ্যের হাতে স্বাধীন আরাকানের পতন ঘটে। আরাকান আর্মি বিভিন্ন সময় আরাকান বা রাখাইনের সেই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের কথা বলেছে। আরাকান আর্মি প্রধান এক সাক্ষাৎকারে (২০২১) বলেন ‘‘আমাদের আসলে ৩০ হাজারের মতো সৈনিক আছে। আমাদের আপাতত ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার সৈনিক দরকার। পূর্ব পূরুষের ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য। আমাদের মূল লক্ষ্য ‘‘রাখিতা’’- হারানো সার্বভৌমত্ব ফিরে পাওয়া”।

তবে এএ এর মুখপাত্র মিঃ খিয়াং থু খা গত ৪ মার্চ এক অনলাইন নিউজ কনফারেন্সে বলেন- ‘‘আমরা পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরাকান রাজ্য গড়ে তুলবো। আমরা স্বাধীনতা চাইনা বরং মিয়ানমারের রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়বো। আমরা চাই কনফেডারেশন’’। অনেক বিশ্লেষক মনে করে যে, আরাকানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন বাস্তব সম্মত নয়। মিয়ানমারের রাজনৈতিক বিশ্লেষক কিয়াও সান হ্লাইং আরাকান আর্মির রাজনৈতিক মতবাদ/শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উল্লেখ করে বলেন ‘‘দলটি রাজনৈতিকভাবে একদলীয় ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে তা স্পস্ট’’।

মূলত রাখাইন অঞ্চলে বৌদ্ধ রাখাইনদের ঐতিহাসিক অধিকারের জন্য লড়ছে এ সংগঠন, যা রাখাইন জনগোষ্ঠির মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। আরাকান আর্মিতে পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি সরব অবস্থান নারীদেরও। পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে বনে জঙ্গলে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে জান্তাবাহিনীর ওপর হামলাও করছে। এএ এর সৈন্যবল ২৫-৩০ হাজার (ইন্টেলিজেন্স ও ‍অক্সিলারী সদস্যসহ) বলে মনে করা হয়।

বিভিন্ন সময় পরিচালিত সামরিক অভিযানে আরাকান আর্মি যেসব অস্ত্র প্রদর্শন করেছে, তাতে স্বয়ং জান্তা বাহিনীও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। আরাকান আর্মির বেশীরভাগ অস্ত্র ও গোলাবারুদের জোগানদাতা কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি ও তাদের মিত্র ‘‘ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি’’। থাইল্যান্ড-মিয়ানমারের সীমান্তে কালোবাজারীদের কাছ থেকে তারা অস্ত্র-গোলাবারুদ ক্রয় করে বলেও জানা গেছে। অসমর্থিত সূত্রের প্রকাশ, ওই সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রভাবশালী কিছু পশ্চিমা দেশ থেকেও অস্ত্র সরঞ্জামাদি আসছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এএ এর বেশীরভাগ অস্ত্র পায় চীন থেকে। আরাকান আর্মির ভান্ডারে উন্নত অস্ত্র ছাড়াও তাদের সদস্যদের জন্য ভালো পোষাক, খাবার ও রেশনের ব্যবস্থা রয়েছে।

রাখাইন আর্মি গেরিলা সংগঠন হলেও এর রয়েছে অনেকগুলো সুগঠিত পদাতিক ব্যাটালিয়ন। উল্লেখ্য এএ এর কয়েক হাজার গেরিলা কাচিন, শান ও সাগাইং অঞ্চলে অন্য জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠি বা ইএও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাতমাদোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ২০১৫ এর আগষ্টে বাংলাদেশের বান্দরবান সীমান্তে এএ গেরিলাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদের এক বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটেছে বলে এএ দাবি করেছিল।

আরাকান আর্মির বর্তমান যুদ্ধ কৌশল
ইন্সারজেন্সি, বৈপ্লবীক যুদ্ধকে সাধারনত ৩ টি পর্বে বিভক্ত করা হয়। সাংগঠনিক পর্ব, গেরিলা যুদ্ধ পর্ব ও সামরিক অভিযান পর্ব। বলা যায়, এএ এখন গেরিলা পর্ব থেকে সামরিক অভিযান পর্বে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গেরিলা ইউনিটগুলো (ব্যাটালিয়ন) এখন প্রায় নিয়মিত বাহিনীর মতো যুদ্ধ করছে। বৌদ্ধ অধিবাসিদের মাঝে ব্যাপক জনসমর্থন থাকায় গ্রামাঞ্চলে জনগনের সঙ্গে মিশে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারছে। আরাকান আর্মি যুদ্ধ করছে দুধর্ষ তামিল টাইগারদের মতো। এএ এর গতিশীল নেতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্ত্র সরঞ্জামাদি ও রেডিও কম্যুনিকেশন আলোচনায় আছে। জান্তা কর্তৃপক্ষ অনেক টাউপশিপে ইন্টারনেট যোগাযোগ, টেলিফোন বন্ধ করলেও এএ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তাদের আভিযানিক যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে আরাকান আর্মির একটি রনকৌশল হলো সীজ বা অবরোধ বা বিচ্ছিন্ন করা। এরই ধারাবাহিকতায় এএ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহর ঘিরে ফেলেছে যেমন মংডু, বুধিডং ও সিতওয়ে। এএ সাম্প্রতিককালে ভিয়েতনামের ভিয়েতকং বা হামাস গেরিলাদের অনুসরনে টানেল তৈরী করছে। এ বছরই তারা প্রথমবারের মতো নৌ-মাইন ব্যবহার করেছে। এর ফলে ইতিমধ্যেই পাউকতাও শহরের যুদ্ধে তাতমাদোর নৌ-বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উল্লেখ্য নদী বন্দর পাউকতাও এর যুদ্ধে তাতমাদো ইতিহাসে প্রথম ‘‘ত্রিমাত্রিক যুদ্ধ’’ পরিচালনা করেছিল। যেখানে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী একত্রিতভাবে এএ কে আক্রমণ করে।

এতোদিন এএ এর রসদ বা লজিসটিকস- বিষয়ক বড় সমস্যা ছিল। তবে চিনের পালেটওয়া দখলের পর ও কালাদান নদী পথ ব্যবহারের ফলে বিষয়টি এখন সহজ হয়েছে। এএ এর আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো- শত শত মাইল দূর্গম পাহাড়ী পথে বিপুল পরিমান অস্ত্র সরঞ্জামাদি শান রাজ্য থেকে সাগাইং-ম্যাগওয়ে-চিন (পালেটোয়া) হয়ে রাখাইনে আনা।

একের পর এক শহরের দখল নিজেদের যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে, তেমনই এটি অন্য গেরিলা দলগুলোকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। গত ৪ মার্চ দলের মুখপাত্র খিয়াং তু খা বলেছেন- ‘‘সম্পূর্ণ রাখাইন রাজ্য দখল নেওয়া পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব’’। মনোবলে বেশ উজ্জিবিত হলেও দুটি বিষয়ের উপর এএ এর আগামী দিনের আভিযানিক অগ্রগতি নির্ভর করছে। প্রথমত সাংগঠনিক। বিশেষত ছোট-দলে গেরিলা যুদ্ধে অভ্যস্থ আরাকান আর্মি ‘‘মোবাইল ওয়ারফেয়ার’’ বা চলন্ত যুদ্ধে কিভাবে ব্যাটালিয়ন আকারের সৈন্যবল অবস্থান পরিবর্তন করবে বা মুভ করাবে। দ্বিতীয়টি হলো কৌশলগত। বর্ষা মৌসুমের আগেই এএ রাজধানী শহর সিথওয়ে ঘেরাও করে প্রচন্ড আক্রমনের মাধ্যমে এটি দখলের চেষ্টা করবে কিনা। তবে এর বিকল্প কৌশল হতে পারে, সিথওয়ের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিরক্ষার অন্যান্য শহরগুলো আগে দখল করা।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর (তাতমাদো) বৃত্তান্ত
আরাকান স্টেটটি সামরিক দিকে থেকে সামরিক বাহিনী বা তাতমাদোর ‘’ওয়েস্টার্ন কমান্ড’’ (রিজিওনাল মিলিটারি কমান্ড) এর অর্ন্তভূক্ত। এর সদর দপ্তর মধ্য আরাকানের ‘‘আন’’ শহরে অবস্থিত। এটি রাজধানি নেপিদোস্থ সেনাসদর থেকে পরিচালিত ‘‘ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশন (বিএসও)-৩’’ এর নিয়ন্ত্রণাধীন। বিএসও অনেকটা পশ্চিমা সেনাবাহিনীর ‘‘আর্মি গ্রুপ’’ কমান্ডের মতো। রাজধানী সিথত্তয়েতে একটি ‘‘রিজিওনাল অপারেশন কমান্ড’’ (স্ট্যাটিক ইউনিট/সদরদপ্তর) রয়েছে। এর কমান্ডার হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিও মিন লাট।

আরাকানে তাতমাদোর ৩টি ‘‘মিলিটারি অপারেশন কমান্ড বা এমও সি (ডিভিশন) মোতায়েন করা আছে। যুদ্ধের বাস্তবতায় একটি লাইট ইনফেন্ট্রি ডিভিশনও (এলআইডি) মোতায়েন হয়েছে এ অঞ্চলে, যা চলন্ত যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উল্লেখ্য, ডিভিশন বলা হলেও তাতমাদোর এমওসিগুলোর (১০ টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন) সৈন্যবল প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ব্রিগেডের প্রায় সমপর্যায়ের। এমওসি-১৫ মোতায়েন রয়েছে উত্তর আরাকানের বুধিডং এলাকায়, যা বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় কাজ করছে।

এমওসি-৯ মোতায়েন রয়েছে চকউতো (উত্তর আরাকান ও চিন সীমান্তে) এলাকায়। উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারী এই এমওসি-৯ এর সদরদপ্তর আরাকান আর্মি দখল করেছে। এর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জও মিনতানকে আটক করেছে এএ। মিনবাও টাউনশিপে ৯ম সেন্ট্রাল মিলিটারি ট্রেনিং স্কুল অবস্থিত। দক্ষিণ আরাকানের টংগপ অঞ্চলে নিয়োজিত রয়েছে এমওসি-৫।

প্রত্যেক এমওসিতে রয়েছে ৩টি করে ‘‘ট্যাকটিকাল অপারেশন কমান্ড বা টিওসি’’ (ব্রিগেড)। প্রত্যেক টিওসি’র আওতায় কাজ করে ৩টি করে পদাতিক ব্যাটালিয়ন। উল্লেখ্য, তাতমাদোর পদাতিক ব্যাটালিয়নের বর্তমান জনবল ২০০-৩০০ এর মতো। বার্মা বিষয়ক গবেষক এনথনি ডেভিসের মতে বর্তমানে আরাকানে তাতমাদোর সৈন্যবল কমপক্ষে ১৫ হাজার। তবে গত ৪ মাসের যুদ্ধে তাতমাদোর জানমালের অপ্রত্যাশিত ক্ষতি হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সিনিয়র কমান্ডার হতাহত হয়েছে। কয়েক বছর রিক্রটমেন্ট বন্ধ থাকায় যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তি বৃদ্ধি (রেইনফোর্সমেন্ট) করা সম্ভব হচ্ছে না। এনথনি ডেভিসের মতে রাখাইন যুদ্ধক্ষেত্রে আরাকান আর্মির সৈন্যবলও ১৫ হাজার এর মতো। যদিও এএ কর্তৃপক্ষ দাবী করছে তাদের জনবল ২৫-৩০ হাজার।

গবেষক এনথনি ডেভিস মনে করেন যে, আক্রমকারী হিসেবে এএ এর এই সৈন্যবল (১৫ হাজার) সুবিধাজনক অবস্থানের নয়। এদিকে তাতমাদোর আরো একটি সুবিধা হলো অন্য রাজ্যের তুলনায় রাখাইন ইয়াঙ্গুনের অধিকতর নিকটবর্তী এবং যেখানে জল ও আকাশ পথে রসদ সামগ্রী পাঠানো সহজতর।

রাখাইনে অবস্থিত ‘‘ধ্যান্যাবাদী রিজিওনাল কমান্ড’’ মিয়ানমারের ৫টি নেভাল রিজিওনাল কমান্ডের অন্যতম। এর রিজিওনাল কমান্ডার হলো কমোডর ট্রে নেইং। আরাকানের চকপিউতে রাখাইনের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনীর ঘাঁটি (ধান্যবাদী নেভাল বেস) অবস্থিত। সিথওয়েতে রয়েছে নির্মাণাধীন ‘‘শোয়েমিন গান’’ নৌঘাঁটি। দক্ষিণ আরাকানের স্যান্ডওয়েতে একটি ছোট নৌঘাঁটি রয়েছে। চকপিউতে স্পেশাল ইকোনমিক জোনের কাছে একটি সাবমেরিন বেজ (ওউনচিয়েন দ্বীপ) গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কালে আরাকান আর্মির আক্রমনে জান্তা নৌ-বাহিনীর (তাতমাদো ইয়াং) ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এএ প্রথম বারের মতো নৌ-মাইন ব্যবহার করেছে।

সিথওয়ে ও আন-এ রয়েছে তাতমাদোর সামরিক বিমান বন্দর। ম্যাগওয়ে রিজিওয়নের (আরাকানের পূর্বে) ম্যাগওয়ে শহরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাঁটি। এখান থেকেই রাখাইনে ফিক্সড উইং বিমানের (যেমন জঙ্গী বিমান) আক্রমন পরিচালনা করা হচ্ছে। বর্তমানে তাতমাদোর স্থল বাহিনী ও নৌবাহিনীর কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হওয়ায় আক্রমণ পরিচালনা ও সরবরাহ ক্ষেত্রে বিমান বাহিনী (তাতমাদো লে) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে জান্তা বিমান বাহিনীর সক্ষমতাও কমছে। আর্থিক সংকট ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জন্য স্পেয়ারস পার্টস ক্রয়, সার্ভিসিং এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যহত হচ্ছে।

সামরিক বাহিনী বা তাতমাদোর কৌশল
৭৫ বছর ধরে অসংখ্য বিদ্রোহি গোষ্ঠির (বর্তমানে প্রায় ২০ টি) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বার্মাকে এখনও একত্রিত রেখেছে তাতমাদো। এই যুদ্ধ- অভিজ্ঞতার জন্য তাতমাদোকে ‘‘জঙ্গল আর্মি’’, ‘‘বাংকার আর্মি’’ বলা হয়। তবে এই দুধর্ষ বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘনের গুরুতর অভিযোগ আছে। তাতমাদোর সামরিক ডকট্রিন হলো- ‘‘আধুনিক সময়ে জনযুদ্ধ’’ (পিপলস ওয়ার আন্ডার মডার্ন কন্ডিশন)। কৌতুককর হলো, তাতমাদো এখন নিজ দেশের জনগনের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তাতমাদো আরাকান আর্মির বিদ্রোহ মোকাবিলায় তাদের নিষ্ঠুর ‘‘কাউন্টার ইনসারজেন্সি’’ কৌশল প্রয়োগ করছে। তাতমাদোর একটি কুখ্যাত কৌশল হলো ‘‘ফোর কাট’’ স্ট্রাটেজি। এর মাধ্যমে তারা যুদ্ধ-কবলিত অঞ্চলে যোগাযোগ, খাদ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এর ফলে রাখাইনের সাধারণ মানুষ চরম কষ্টের মধ্যে আছে।

আরাকান আর্মি মিয়ানমারের এই ‘নতুন ফ্রন্টে’ জান্তা সরকার (স্টেট এডমিনিসট্রেশন কাউন্সিল) এর সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। বর্তমান ‘‘ব্যাটল ডিনামিক্সে’’ (যুদ্ধ গতিপথে) অনেক কৌশলগত পরিবর্তন এসেছে। জান্তা বাহিনী বর্তমানে ব্যাপকভাবে বিমান আক্রমন ও আর্টিলারী আক্রমন চালাচ্ছে। এতে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক হতাহত, বাস্তুচ্যুত ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, এই যুদ্ধ এখন গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। আরাকান আর্মির অব্যাহত যুদ্ধ জয়ে অনেক এলাকা ও ভূমি নিয়ন্ত্রনের ফলে তাতমাদো রাখাইনের গুরুত্বপূর্ণ জলপথ ও সড়কপথ ব্যবহার করতে পারছে না। এর ফলে সৈন্য প্রেরণ ও রসদপত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে আকাশ পথই (বিমানবাহিনী) এখন প্রধান ভরসা। এএ এর তীব্র আক্রমণের মুখে ‘‘প্রতিরক্ষামূলক (ডিফেনসিভ) অবস্থান’’ নিয়েছে এই বাহিনী।

যুদ্ধের বলী রাখাইনের সাধারণ জনগণ
গত প্রায় ৩ মাস ধরে জান্তাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে সড়ক ও জল পথে চলাচল বন্ধ রেখেছে। তাতামাদো কুখ্যাত ‘ফোর কাট কৌশল’ প্রয়োগ করছে। ফলে সাধারণ জনগনের দুর্ভোগ বিশেষত খাদ্যাভাব এখন চরমে। উত্তর আরাকানে সীমান্ত বাণিজ্যসহ সাধারন ব্যবসা বাণিজ্যও প্রায় বন্ধ। এএ দখলকৃত শহরগুলো এখনো জনশূন্য। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির জন্য এএ অধিকৃত এলাকাতেও চলাচল সীমিত। তাতমাদোর বিমান ও গোলন্দাজ আক্রমনে শত শত বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে।

এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে রাখাইনের প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন বলছে ২০২১ সালের পর অদ্যাবধি গৃহযুদ্ধে মিয়ানমারের প্রায় ২৭ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। রাখাইনের জনসাধারণ বর্তমান সংঘাত নিয়ে কি ভাবছে? এ প্রসঙ্গে ‘‘দি ইরাবতী” লিখেছে ‘‘রাখাইনের জনগন এএ এর বিজয়ে উৎসাহিত। কিন্তু তারা চায় এই যুদ্ধ এখনই থামুক। অনাহারের ফলে তাঁরা খুব কষ্টে আছে“। বলা যায়, রাখাইন এখন দূর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে।

আরাকান যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি
বর্তমানে মংডু, রাথেডং, বুথিডং ও সিথওয়ে শহরের আশেপাশে প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে। রাজ্যের রাজধানী তথা প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র হলো সিথওয়ে বা আকিয়াব শহর। যুদ্ধের ভয়ে এলাকার অধিকাংশ অধিবাসী শহর ছেড়ে পালিয়েছে। বিশেষত স্বচ্ছল নাগরিকগণ রেঙ্গুনে চলে গেছে। বর্তমানে সিথওয়ে শহরে মূলত রোহিঙ্গারাই আছে। কারণ তাঁদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই।

সিথওয়ের ‘‘ছাপায়া কোয়ার্টার’’ এলাকায় মিন পেইং জিন রোডের নীল রংয়ের সুদৃশ্য ২ নং বাড়িটি এখন বন্ধ। এটিই সিথওয়ের বাংলাদেশ কনসুলেট অফিস। নিরাপত্তার অভাবে বাংলাদেশের কুটনীতিকগণ এখন সবাই রেঙ্গুনে। তাতমাদো কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাদেশিক রাজধানী শহর রক্ষার জন্য ব্যাপক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছে। এদিকে শহরের দিকে অগ্রসরমান আরাকান আর্মি সিথওয়েস্থ ‘‘রিজিওনাল অপারেশন কমান্ডকে’’ অস্ত্র সমর্পণের জন্য আহবান জানিয়েছে। জানা গেছে, রাজধানীর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাশাসনিক কর্মকর্তাকে দক্ষিণ দিকের শহর থানডোয়েতে স্থানান্তর করা হয়েছে।

৩ মাস প্রচন্ড যুদ্ধের পর, গত ১১ মার্চ রাখাইনের দক্ষিণে অবস্থিত রামরি দ্বীপের রামরি শহরের দখল নিয়েছে এএ। এই শহরের নিকটবর্তী চকপিউতে চীনের সহায়তায় গভীর সমুদ্রবন্দর ও চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ চলছে। চকপিউ থেকে চীনের ইউনান পর্যন্ত ১৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অর্থনৈতিক করিডোর চালু করেছে বেইজিং। যার মাধ্যমে চীন সরাসরি বঙ্গোপসাগর/ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এভাবে যুদ্ধ এখন অত্যন্ত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই চকপিউ অঞ্চলে পৌঁছেছে। তবে সিথওয়ে ও চকপিউ অঞ্চল ধরে রাখার জন্য তাতমাদো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে।

৯ টি শহর পতনের আলোকে আরাকান আর্মি রাখাইনে অবশিষ্ট সকল জান্তা বাহিনীর ইউনিট/বেসকে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়েছে। এএ বলছে তারা আক্রমন বৃদ্ধি করেছে এবং সকল ঘাঁটির দখল না করা পর্যন্ত তারা এই আক্রমণ থামাবে না।

বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাতমাদোর নতুন কৌশল
দেশব্যাপী বিরোধী শিবিরের টানা প্রতিরোধ এবং বিশেষ করে এএ এর কাছে রাখাইনের বিশাল এলাকার (প্রায় অর্ধেক) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা সরকার এখন একেবারেই কোনঠাসা। অবস্থা বুঝে সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর অনেকেই জান্তার পক্ষ ছেড়ে বিরোধি শিবিরে যোগ দিয়েছে। টিকে থাকার জন্য নেপিডো জান্তা-সরকার মরিয়া হয়ে বেশকিছু অদূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি গণচীনের মধ্যস্থতায় থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সঙ্গে একটি যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে দুই পক্ষের সঙ্গেই খেলছে চীন। ব্যাপক প্রাণহানির কারণে জান্তা সরকার ১০ ফেব্রুয়ারী ঔপনিবেশিক আমলের কন্সক্রিপশন আইন বা বাধ্যতামূলক সামরিক চাকুরীর বিষয়টি পুনরুজ্জীবিত করে। কিন্তু আইন করেও জান্তা সরকার আশানুরূপ ফল পায়নি। মিয়ানমারের ওই বয়সের যুবক-যুবতীরা অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকেই দেশ ছাড়ার পায়তারা করছে।

রাখাইনে এখনও প্রায় সোয়া ৬ লক্ষ রোহিঙ্গা রয়েছে। জান্তা-সরকার শেষমেষ দলে টানার চেষ্টা করছে এই অসহায় রোহিঙ্গাদের। যাদের উপর ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে তারাই ২০১৭ সালে প্রায় ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। এখন তারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে জান্তার হয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে। এভাবে তারা রণাঙ্গনে রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মির মুখোমুখি করার ও মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহারের অপকৌশল নিয়েছে।

ইতোমধ্যে কয়েকশো রোহিঙ্গা তরুনকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার সংবাদ মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে। এদিকে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা তরুনদের সামরিক প্রশিক্ষণ না নিয়ে পালিয়ে যেতে বলছে। উল্লেখ্য অতীতে বিভিন্ন সময় জান্তা সরকার অত্যন্ত কৌশলে রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে রেখেছে।

এ দিকে এএ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের এক ধরণের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়। কিছু কিছু প্রশাসনিক কাজেও রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারাও আরাকান আর্মিতে যোগ দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উদার হলেও এএ এখনও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকারকে সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।

আগামীতে রাখাইনে কি হতে যাচ্ছে?
এএ এখন পর্যন্ত ১৮০ টির বেশী জান্তা ঘাঁটি এবং ফাঁড়ি দখল করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৬ টি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। একই সঙ্গে তারা রাখাইন রাজ্যর ৯ টি শহরঃ চকউতো, পাউকতো, মিনবায়া, ম্রাউক-উ, তাংপিও লেট ইয়ার, মিয়াবান, পান্নাজিওন, রামরি ও রাথেডং দখল করেছে।

এখন উত্তর রাখাইনে যুদ্ধ চলছে টেকনাফ অঞ্চলের ওপারে। এখানে এমওসি-১৫ (ডিভিশন) মোতায়েন রয়েছে। এর সদর দপ্তর হলো বুধিডং-এ। মংডুতে বিজিপির গুরত্বপূর্ণ সদরদপ্তর রয়েছে। হারোনো ঘাঁটিগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য আগামী দিনে তাতমাদো রাখাইনের এএ অবস্থানের উপর সর্বাত্মকভাবে আক্রমণ করতে পারে। বিশেষত যদি মিয়ানমারের অন্য ফ্রন্টে গেরিলাদের আক্রমনের গতি কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে, উত্তর ও মধ্য রাখাইনের যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ লাভ করবে। তখন ২০১৭ এর মতো রোহিঙ্গা ঢল, এমনকি রাখাইন ঢলও নামতে পারে। অন্যদিকে এএ এর আক্রমনে মংডু ও বুধিডং এর পতন হলে জান্তা সরকারের শত শত সীমান্তরক্ষী ও সেনা সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার সম্ভাবনা আছে।

ধারনা করা হচ্ছে যে, আগামী দিনগুলোতে মংডু, বুধিডং, সিথওয়ে ও চকপিউ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার লড়াই অত্যন্ত রক্তপাতময় হতে পারে। এইসব অঞ্চলে তাতমাদো নিজেদের রক্ষার জন্য ব্যাপক ধ্বংষযজ্ঞ চালাতে পারে, বিশেষত বিমান, নৌ ও গোলন্দাজ শক্তির সাহায্যে। এর জন্য বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। তাতমাদোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো, যুদ্ধ বিরতি ও শান্তি আলোচনা। তারা এক ফ্রন্টে যুদ্ধ বিরতি স্থাপন করে, অন্যফ্রন্টে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। রাখাইনের ক্ষেত্রেও এমন হতে পারে।

কোন কোন বিশ্লেষক মনে করেন, এ বছরের মধ্যেই আরাকান আর্মির হাতে সমগ্র রাখাইনের পতন হবে। গত ১২ মার্চ ২০২৪ থেকে রাখাইনের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এপ্রিলের ২য় সপ্তাহে মিয়ানমার ও রাখাইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ‘‘থিনজিয়ান বা সাংক্রান (জল উৎসব)’’ অনুষ্ঠিত হবে। এ বিষয়গুলো আরাকান আর্মির সামরিক অভিযানকে ব্যাহত করতে পারে। এ দিকে আগামী মে মাস থেকে মিয়ানমারে বর্ষা মৌসুম শুরু হচ্ছে। এর ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাতময় এই সময় বিশেষত মে-অক্টোবর উভয় বাহিনীর জন্যই যুদ্ধকে কঠিন করে ফেলবে। অর্থাৎ এই বছরের মে মাসের মধ্যে অর্থাৎ বর্ষা আসার আগে আরাকান আর্মি অধিকতর বড় আভিযানিক অগ্রগতি অর্জন না করলে এ বছরটি হয়তো রাখাইন এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঞ্চল ধরে রাখতে সক্ষম হবে তাতমাদো। এই অচলাবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও কুটনৈতিক সুবিধা পাবে জান্তা সরকার। ডুবন্ত জান্তা সরকারের জন্য যেটি হবে লাইফ লাইন।

রাখাইনের পতন নিয়ে চুড়ান্ত কথা বলার সময় এখনও হয়নি। রাখাইনে যুদ্ধ জান্তা সরকারের এক ধরনের বাঁচা-মরার লড়াই। রাখাইনকে তারা মোটেই সহজে ছেড়ে দেবে না। এছাড়াও চকপিউ অঞ্চলে চীনের মহাগুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগের জন্য চীনের মধ্যস্থতায় এক ধরনের সমঝোতা ও হতে পারে। এএ বেশী থেকে বেশী অঞ্চল দখল করে নিগোসিয়েশনে শক্তিশালী অবস্থানে থাকার চেষ্টা করবে। বৃহত্তর স্বায়ত্বশাসন যেমন শান রাজ্যের ওয়া স্টেটের মতো মর্যাদায় আরাকান আর্মি কেন্দ্রের সঙ্গে সমঝোতাও করতে পারে।

তাতমাদো অত্যন্ত শক্তিশালী, দক্ষ, কৌশলী ও চতুর একটি প্রতিষ্ঠান। যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৭ দশক মিয়ানমার শাসন করেছে। নিজ জনগণের উপর গনহত্যা, নির্যাতন চালানোর ফলে তাতমাদো এখন জন বিচ্ছিন্ন। তারা মনোবলও হারিয়েছে। তবুও দীর্ঘ সময় ধরে দেশ পরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান থাকায়, অতীতে বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে তারা জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলোর আন্দোলন ম্যানেজ করেছে বা চরম নিষ্ঠুরভাবে তা প্রতিরোধ করেছে। যদি চলমান সকল ফ্রন্টে গেরিলা দলগুলোর অব্যাহত চাপ থাকে, বিশেষত কেন্দ্রিয় বামার হার্টল্যান্ডে বামার জনগোষ্ঠির ‘‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’’ ও আক্রমণ অব্যাহত রাখে। একই সঙ্গে যদি চীন জান্তা সরকারের ওপর থেকে সমর্থণ প্রত্যাহার বা অন্তত পক্ষে নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে হয়তো এক বছরের মধ্যে আরাকান আর্মি সম্পূর্ণভাবে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হবে।

শেষের কথা
একটা বিষয় নিশ্চিত যে, সময় সাপেক্ষ হলেও রাখাইনে বড় ধরণের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এবং তাতমাদোর এমন শক্তিশালী অবস্থানে আর থাকবে না। ফলাফল যাই হোক, রাখাইনের যুদ্ধ কোনভাবেই জান্তা সরকারকে দীর্ঘ দিন বাঁচিয়ে রাখবে না। এই সরকার ইতোমধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের কেন্দ্রে কাবুলের মতো জান্তা সরকারের পতন না হলেও চীনের মধ্যস্থতায় আলোচনার মাধ্যমে বড় ধরনের পরিবর্তন হতে পারে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের নিজ নিজ ভূ-রাজনীতির স্বার্থে রাখাইনে আরো জটিল পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে। এটি প্রক্সি যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্রও হতে পারে। আবার অপ্রত্যাশিত নতুন কিছু সম্ভাবনাও আসতে পারে।

রাখাইনের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। ২০০৮ সালে মংডু শহরে আমার দেখা সরকারি হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধ করে এটিকে এখন সেনা ক্যাম্পে পরিনত করা হয়েছে। ঢাকার উচিত রাখাইন যুদ্ধ- পরিস্থিতি গভীরভাবে মনিটর করা। বিগত বছরগুলোতে এ বিষয়ে অনেক দূর্বলতা ছিল। বাংলাদেশকে নতুন পরিস্থিতির আলোকে নিজের স্বার্থ বিশেষত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, সীমান্ত নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য কূটনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এর মধ্যে অন্যতম হলো- সামরিক ক্ষেত্রে ‘‘ক্রেডিবল’’ ‘‘ডেটারেন্স’’ অর্জন।

রাখাইনে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশের ‘‘কনফ্লিক্ট অব ইনটারেস্ট’’ হতে পারে। কারও উপর নির্ভরশীল না হয়ে, নিজস্ব কূটনীতি-কৌশল দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার ও সংকটমুক্ত হয়ে বিপদ কাটাতে হবে। রাখাইনের নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে বান্দরবানের পূর্ব সীমানায় অবস্থিত (৭৫ কিলোমিটার সীমান্ত) মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পরিস্থিতিও মনিটর করা প্রয়োজন। যা বাংলাদেশে খুব কম আলোচনা হয়। সেখানে ‘‘চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’’ প্রায় ৭০% এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। চিন ও রাখাইনের উত্তাপ, উত্তেজনা যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত না করে সেটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার।

বাংলাদেশের উচিত আরাকান আর্মি ও প্রবাসী ‘‘জাতীয় ঐক্য সরকার’’ (এনইউজি) এর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা। একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের সম্পর্ক স্থাপন করা। এখানে বর্তমান নেতৃত্বের দক্ষতা ও দূরদর্শিতা প্রদর্শনেরও একটি বড় সুযোগ ও পরীক্ষা। যুদ্ধ-শেষে শান্তি নামুক অপরূপ আরাকানে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক
bayezidsarwar792@gmail.com

Comment here