রোহিঙ্গা সমাচার

রোহিঙ্গারা ঢুকছেই, ক্যাম্পের কাছে উঠছে নতুন ঘর : বিজিবি ফিরিয়েছে প্রায় দেড় শ, চার দালাল আটক

 

তোফায়েল আহমদ, এস এম রানা ও জাবেদ ইকবাল, কক্সবাজার

রোহিঙ্গারা ঢুকছেই, ক্যাম্পের কাছে উঠছে নতুন ঘর

মিয়ানমারে তাণ্ডবের শিকার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন করে মাটির ঘর তৈরি করা হচ্ছে। সকালের চিত্র। ছবি : কালের কণ্ঠ

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক তাণ্ডবের শিকার হয়ে মংডুর রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রেখেছে। ওপারে নির্যাতনের শিকার হয়ে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে বাধার মুখে পড়ছে তারা। তার পরও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা এরই মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কত হবে কেউ বলতে না পারলেও তা তিন শতাধিক হতে পারে বলে আভাস মিলেছে। যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারা এলাকায় থিতু হওয়ার আগেই ঘর বানানোর কাজে লেগে যাচ্ছে।

নাফ নদ দিয়ে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) স্থলভাগে পাহারার পাশাপাশি নদেও স্পিডবোট নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। সোমবার রাতে পাহারার সময় বিজিবি সাতটি নৌকায় থাকা ৮০-৯০ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে বাধা দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। অনুপ্রবেশ চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে চেষ্টাকারী সাতটি নৌকা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানিয়েছেন, পালংখালী বিওপি এবং রেজুখাল যৌথ চেকপোস্টের সদস্যরা সীমান্তের শূন্য রেখা থেকে ৩৭ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছে।

অন্যদিকে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আবুল খায়ের জানিয়েছেন, বিজিবি রোহিঙ্গা প্রবেশে সহযোগিতা দেওয়ার অভিযোগে চার দালালকে আটক করে থানায় সোপর্দ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

রোহিঙ্গারা আসছেই : উখিয়ার কুতুপালং এলাকার অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই-২ ব্লকে দাঁড়িয়ে কথা হয় মঙ্গলবার নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রাইজুমা বেগম, রিজিয়া বেগম, নূরজাহান, নূর নাহারসহ আরো অনেকের সঙ্গে। তাঁরা জানান, সাত দিন আগে তাঁদের দলটি মংডুর কিয়ারিপাড়া এলাকা থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। কিন্তু তাঁরা অনুপ্রবেশ করতে পারছিলেন না। বনেজঙ্গলে ঘুরে কিংবা পাহাড়ি ঘরে আশ্রয় নিয়ে সাত দিন পর তাঁরা মঙ্গলবার কুতুপালং এলাকায় এসে পৌঁছেন। তাঁদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সাত দিন আগে পোড়া বসতভিটা ফেলে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেন। নাফ নদের তীরে এসে জনপ্রতি ২৫ হাজার কিয়াত (মিয়ানমার মুদ্রা) দিয়ে নাফ নদ পার হন। এপারের দালালদের দেন জনপ্রতি আরো দুই হাজার টাকা করে। এরপর পাহাড়ি জঙ্গল পাড়ি দিয়ে তাঁরা কুতুপালং ক্যাম্পে পৌঁছেন।

একইভাবে মংডুর রিমাতং এলাকা থেকে কুতুপালংয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানায়, তারা হ্নীলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। কুতুপালং ক্যাম্পে অভুক্ত অবস্থায় পৌঁছার পর তারা একটি ঘরে আশ্রয় নিয়েছে।

কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানিয়েছে, এখন প্রতি রাতেই রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। উখিয়া ও টেকনাফের অনিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোতে প্রথমে আশ্রয় নিচ্ছে। পরে সেখান থেকে সুবিধাজনক স্থানে চলে যাচ্ছে পরিবারগুলো।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক হারুন সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হোয়াইক্যং ইউনিয়নের তুলাতলী ও উলুবুনিয়া সীমান্ত দিয়ে সোমবার রাতে বহু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। শুধু এই দুটি পয়েন্ট দিয়ে নয়, সীমান্তের অনেক পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে বলে জানতে পেরেছি।’

নির্মিত হচ্ছে নতুন ঘর : মঙ্গলবার দিনভর উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে নতুন করে আসা শত শত রোহিঙ্গা নাগরিককে। মঙ্গলবার ভোরেও দেড়-দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নাগরিক কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের বিভিন্ন ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ঘরে জায়গা নেই তাই এই ক্যাম্পের রোহিঙ্গা পরিবারগুলো নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে পারছে না। অভাবের কারণে তাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থাও করা যাচ্ছে না। স্থান সংকট এড়াতে রোহিঙ্গারা বন বিভাগের বনভূমিতে অবৈধভাবে নতুন করে বসতঘর নির্মাণ করছে।

মঙ্গলবার ওই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে বেশ কিছু মাটির ঘর নির্মাণাধীন অবস্থায় আছে। পাহাড়ের মাটি কেটে আগে থেকেই তৈরি করা অবৈধ বসতঘরের পাশে নতুন এসব ঘর নির্মিত হচ্ছে। কুতুপালং ক্যাম্পের একাধিক পাহাড়ে নতুন ঘর নির্মিত হচ্ছে। কোনোটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে, কোনোটির চালে বাঁশ বাঁধা হচ্ছে।

ঘর নির্মাণ বিষয়ে কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি মোহাম্মদ নূর বলেন, আগতরা এখানে পৌঁছার পর নিজেরা থাকার জন্য ঘর তৈরির চেষ্টা করছে। কমিটি কাউকে ঘর করে দিচ্ছে না।

২ ডিসেম্বর মংডুতে যাচ্ছেন কফি আনান : গতকাল মিয়ানমার পৌঁছেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। আগামী ২ ডিসেম্বর শুক্রবার রাখাইন রাজ্যের মংডুতে যাওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। তিনি অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারের রোহিঙ্গাবিষয়ক কমিশনের প্রধান। তিনি মিয়ানমারের মংডুতে চলমান সহিংসতার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন বলে জানা গেছে।

কফি আনানের সম্ভাব্য পরিদর্শনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মংডুতে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থার এক সদস্য। তিনি জানান, মিয়ানমার সরকার পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের সমালোচনা করছে। মিয়ানমার মনে করছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো উসকানি দিয়ে রিপোর্ট করছে। অহেতুক রাখাইনদের জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। মংডু ডিস্ট্রিক্টের প্রশাসক (ডিসি) উ য়েট টেট এমন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে একজন এনজিও কর্মকর্তা জানান।

মংডুতে ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে বৈঠক বাতিল : ‘মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা চলছে’ ‘ইউএনএইচসিআরে’র কক্সবাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত জন ম্যাককেসিনের করা এমন মন্তব্যে মিয়ানমার সরকার নাখোশ বলে জানা গেছে। এর জের ধরে ইউএনএইচসিআরের মংডু অফিস প্রধান মিস উরারার সঙ্গে গত রবিবারের নির্ধারিত একটি বৈঠক বাতিল করেন মংডুর ডিসি।

Comment here