আন্তর্জাতিক

বিপ্লবী কিংবদন্তির বিদায়

ফিদেল কাস্ত্রো
১৯২৬-২০১৬

টেকনাফ ভিশন ডেস্ক

বিপ্লবী কিংবদন্তির বিদায়

 

নিষ্পেষিত ও মেহনতি মানুষকে তিনি দিয়েছেন সংগ্রামের ভাষা, বিপ্লবের মশাল জ্বালিয়ে দেখিয়েছেন মুক্তির পথ। সাম্রাজ্যবাদী ঝড়ের দাপটের কাছে অন্যরা যখন অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে, তখন তিনি সিনা টান করে দাঁড়িয়েছেন। মাতৃভূমি থেকে বলিষ্ঠ হাতে উপড়ে ফেলেছেন পুঁজিবাদের শিকড়। ইস্পাত-দৃঢ়তায় উঁচিয়ে ধরেছেন সেই মশাল। দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে কোটি প্রাণে তারই স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়ে অবশেষে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো (৯০)। স্থানীয় সময় গত শুক্রবার রাত ১০টা ২৯ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টা) রাজধানীর হাভানায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

স্বাস্থ্যগত কারণে ২০০৮ সালে ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হস্তান্তরের পর থেকেই আড়ালে চলে যান কাস্ত্রো। রাউলই গত শুক্রবার মধ্যরাতের পর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া ঘোষণায় জাতিকে এ দুঃসবাদ দেন। ছোট্ট ঘোষণায় তিনি শুধু বলেন, ‘কিউবা বিপ্লবের প্রধান সেনাপতি ফিদেল কাস্ত্রো রুজ রাত ১০টা ২৯ মিনিটে মারা গেছেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী শনিবার (গতকাল) সকালে মরদেহ দাহ করা হবে।’ তবে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু না জানিয়ে কিউবা বিপ্লবের জনপ্রিয় স্লোগান ‘হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিয়েম্প্রে (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক)’ বলে ঘোষণা শেষ করেন রাউল।

পরে নির্বাহী ঘোষণায় জানানো হয়েছে, কাস্ত্রোর মৃত্যুতে ৯ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে কিউবা। এ সময় কাস্ত্রোর দেহভস্ম কয়েকটি ভাগে ভাগ করে চার দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। পরে আবার সেগুলো এক জায়গায় করে আগামী ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমের ঐতিহাসিক শহর সান্তিয়াগোতে সমাহিত করা হবে, যেখানে স্কুল ও কলেজজীবনের লম্বা সময় কেটেছে কাস্ত্রোর। যে শহরের সিটি হলের ব্যালকনি থেকে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি কিউবা বিপ্লবের বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।

ক্যারিবীয় সাগরে ৪২ হাজার ৪২৬ বর্গমাইল আয়তনের দ্বীপপুঞ্জ কিউবাকে একসময় নিজেদের অবকাশযাপন কেন্দ্র বানিয়ে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতায় বসিয়েছেল তাদের পোষা সরকার। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সেই সরকারকে ক্ষমতাছাড়া করেন কাস্ত্রো। দেশ ফিরিয়ে দেন জনগণের হাতে। যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে প্রতিষ্ঠা করেন সমাজতন্ত্র, ফ্লোরিডার দক্ষিণ উপকূল থেকে যার দূরত্ব মোটে ৯০ মাইল। যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়েছে, অবরোধ আরোপ করেছে, মার্কিন গোয়েন্দারা হত্যার ছক কষেছে, বিরোধীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কিউবায় পাঠিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ করানোর চেষ্টা করেছে; কিন্তু টলাতে পারেনি কাস্ত্রোকে। তাঁর আমলে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ প্রেসিডেন্ট বদল হয়েছেন। তাঁদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাস্ত্রো এক হাতে কিউবা শাসন করে গেছেন টানা ৪৯ বছর ধরে।

বিরোধীদের চোখে তিনি ছিলেন ‘স্বৈরাচার’, কট্টর পুঁজিবাদী দেশগুলোর কাছে তাঁর পরিচয় ছিল ‘একনায়ক’; বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে তিনি ছিলেন ‘আস্থার প্রতীক’, অনুসারীরা তাঁকে চিনত ‘এল কমান্দান্তে (দ্য কমান্ডার)’ হিসেবে, আর মুক্তিকামী সংগ্রামী সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি।

২০০৬ সালে বড় ধরনের অসুখে পড়েন কাস্ত্রো। স্বাস্থ্যগত কারণে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা যেত না। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় কলাম লেখা ছাড়া সেভাবে তাঁর খবর মিলত না। কালেভদ্রে দু-একটা ছবি প্রকাশ করা হতো কেবল। এর মধ্যে গত আগস্টেই ঘটা করে কাস্ত্রোর ৯০তম জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে সবাইকে নিয়ে কেক কেটেছিলেন কাস্ত্রো, দিয়েছিলেন বক্তৃতা। সেটাই সর্বশেষ তাঁর প্রকাশ্যে আসা, সর্বশেষ বক্তৃতা।

ছোট থেকেই ডানপিটে : কাস্ত্রোর পুরো নাম ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ, জন্ম ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় ওরিয়েন্তে প্রদেশে বিরান শহরের (বর্তমানে সেটি পড়েছে অলগিন প্রদেশে) কাছে। স্পেন থেকে কিউবায় অভিবাসী বাবা অ্যাঞ্জেল কাস্ত্রো আখ চাষ করে বিস্তর পয়সা করেছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে ছিলেন কাস্ত্রো। পড়াশোনার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছিল সান্তিয়াগোতে। তবে পড়ার চেয়ে খেলাধুলাতেই বেশি মন ছিল তাঁর। শিক্ষকদের কথা শুনতেন না, সহপাঠীদের সঙ্গেও হুটহাট মারামারি বেধে যেত। সান্তিয়াগোতে দুই স্কুল ঘুরে শেষে ফেরেন হাভানায়। সেখানে কলেজ পেরিয়ে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব হাভানায়, বিষয় ছিল আইন। সেখানে পড়ার সময়ই জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। সে সময়েই তরুণ কাস্ত্রোর মনে কিউবান জাতীয়তাবোধ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাতের ছাপ পড়ে।

বাবার পয়সা ছিল, বিয়েও করেছিলেন ধনী পরিবারে। চাইলে আইনজীবী পেশা বেছে নিয়ে আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারতেন পুরো জীবন। কিন্তু সেই পথে হাঁটেননি কাস্ত্রো। বেনিয়া অভিজাত গোষ্ঠীর পক্ষ নেওয়ার বদলে তিনি বেছে নেন জনতার পক্ষ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা পরাশক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে দেশে দেশে যখন পুতুল সরকার ক্ষমতায় বসতে থাকে, বিস্তার হতে থাকে নব্য উপনিবেশবাদের জাল, পুঁজিবাদ-মুনাফার দুষ্টচক্রে পড়ে যখন নিপীড়িত মানুষের আহাজারি বাড়তে থাকে, বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন সাহায্যের নামে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদের থাবা মেলতে থাকে, তখন বিপ্লবের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে আবির্ভাব হয়েছিল ফিদেল কাস্ত্রোর।

যেভাবে বিপ্লবের পথে : ১৯৪৭ সালে ডমিনিকান রিপাবলিকে তখনকার স্বৈরশাসক রাফায়েল ত্রুজিলোকে উত্খাতে বিদ্রোহে অংশ নেন কাস্ত্রো। সেখানে ব্যর্থ হন, তবে দমে যাননি। পরের বছর চলে যান কলম্বিয়ার বোগোটায়। সেখানে তাঁকে দেখা যায় সরকারবিরোধী দাঙ্গায়। ওই বছর কাস্ত্রো যোগ দেন সংস্কারপন্থী দল ‘পার্টি দ্য অর্তোদক্সোতে (অর্থোডক্স পার্টি)’। কমিউনিস্টবিরোধী এ দলের প্রার্থী এদুয়ার্দো চিবা ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেও ফিদেল তাঁকে পুনরায় নির্বাচন করতে প্রেরণা জোগান।

এ সময়ই মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন কাস্ত্রো। একই সঙ্গে কিউবান কংগ্রেস নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট জেনারেল ফুলগেনসিও বাতিস্তা কিউবার নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নেন। ক্ষমতায় বসেই পরবর্তী নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন তিনি। তত দিনে পুঁজিবাদের অন্দরমহলটা চেনা হয়ে গেছে কাস্ত্রোর। সঙ্গীদের নিয়ে স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটানোর পরিকল্পনা করতে থাকেন। গঠন করেন বিপ্লবী সংগঠন ‘দ্য মুভমেন্ট’। ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই দ্য মুভমেন্টের ১৫০ জন সদস্য কিউবার সান্তিয়াগোতে থাকা মানকাদা মিলিটারি ব্যারাকে আক্রমণ করেন। তাতে ব্যর্থ হলে বাতিস্তা সরকার কাস্ত্রোকে বন্দি করে। এরপর বিচারে তাঁর ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়। শুনানিতে টানা চার ঘণ্টা নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন কাস্ত্রো। শুনানিতেই তরুণ কাস্ত্রো বিচারকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার নিন্দা করতে পারো। তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে।’

দ্রুতই সেই ভাষণ ছড়িয়ে পড়ে, যা কাস্ত্রোকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে। বিচারে ফিদেলের অন্য সহযোগীদেরও নানা মেয়াদে সাজা হয়, এর মধ্যে রাউলও ছিলেন।

কারাগারে থাকার সময় ফিদেল তাঁর দলের নাম বদলে রাখেন ‘টোয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই মুভমেন্ট’। ১৯৫৫ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে সহযোগীদের নিয়ে মেক্সিকোতে পাড়ি জমান কাস্ত্রো। সেখানেই দেখা হয় আর্জেন্টাইন বিপ্লবী চে গুয়েভারার সঙ্গে; চিকিৎসক গুয়েভারাও তখন স্বপ্ন দেখছিলেন পুরো দক্ষিণ আমেরিকা বদলে দেওয়ার।

মেক্সিকোতে চে’র সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক হয় কাস্ত্রোর। পরে তাঁরা কিউবায় ফিরে বাতিস্তা সরকার উত্খাতের পরিকল্পনা করেন। ১৯৫৬ সালের ২ ডিসেম্বর ৮১ জন সহযোগী ও অস্ত্রশস্ত্রসহ ছোট্ট নৌকা ‘গ্রানমায়’ চেপে কিউবার উত্তরাঞ্চলের মানজানিলোতে নামার পরিকল্পনা করেন ফিদেল কাস্ত্রো। তবে গুপ্তচররা সেই খবর জানিয়ে দেয় বাতিস্তা সরকারকে। তাঁদের শায়েস্তা করতে বাতিস্তা সেখানে সৈন্য পাঠান। কাস্ত্রোরা নৌকা থেকে নামলে গুলি চালায় বাতিস্তা বাহিনী। নিহত হয় বেশ কয়েকজন। চে ও রাউলসহ বেঁচে যাওয়া সঙ্গীদের নিয়ে কিউবার সিয়েরা মায়েস্ত্রোর পার্বত্য জঙ্গলে ঘাঁটি গাড়েন কাস্ত্রো। শুরু হয় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ। তাতে ব্যাপক সমর্থন দিতে থাকে কিউবার জনতা। ১৯৫৮ সালের শেষের দিক কাস্ত্রো বাহিনী একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। চূড়ান্ত লড়াইয়ে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি কিউবা দখলে নেয় কাস্ত্রোর বাহিনী। বাতিস্তা পালিয়ে যান ডমিনিকান রিপাবলিকে।

ক্ষমতায় কাস্ত্রো : ফিদেল কাস্ত্রোর সমর্থন নিয়ে ১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ম্যানুয়েল উরুতিয়া; হোসে মিরো কর্দোনা হন প্রধানমন্ত্রী। সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন কাস্ত্রো। তবে পরের মাসেই মিরো পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী হন ফিদেল। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কারখানা ও খামারগুলো জাতীয়করণ করেন তিনি, করেন ভূমি সংস্কার। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে কাস্ত্রো সরকারের। ওই বছরের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কাস্ত্রো। তবে চেষ্টা করেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি। মে মাসে কিউবায় ফিরে করেন ‘ফার্স্ট এগ্রেরিয়ান রিফর্ম অ্যাক্ট’। এ আইনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, বিদেশি কম্পানির সম্পদ জাতীয়করণ করা হয়। বছরের শেষ ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে চেষ্টা চালান কাস্ত্রো। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও তেল কেনার চুক্তি করেন কাস্ত্রো। যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন কম্পানিগুলো এ তেল পরিশোধনে আপত্তি জানালে কাস্ত্রো তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেন। জবাবে যুক্তরাষ্ট্র কিউবা থেকে চিনি কেনার নির্ধারিত কোটা বাতিল করে, আরোপ করে নিষেধাজ্ঞা।

স্নায়ুযুদ্ধকালীন সংকট : ১৯৬১ সাল ছিল কাস্ত্রোর জন্য সবচেয়ে সংকটময়। বছরের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এপ্রিলে কাস্ত্রো কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। ওই বছরই কিউবা থেকে পালিয়ে যাওয়া প্রায় দেড় হাজার দেশত্যাগী যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর প্রশিক্ষণে কিউবার ‘বে অব পিগে’ ফিরে ফিদেলকে উত্খাতের চেষ্টা চালায়। তবে তারা ব্যর্থ হয়।

এরপর নিজেকে মার্কস-লেনিনের অনুসারী ঘোষণা করেন কাস্ত্রো। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক নীতি দেশ পরিচালনার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে বলে জানান। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তত দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চেপে বসেছে। ওই বছরের অক্টোবরে তুরস্কে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। জবাবে কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো ও সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভ। একপর্যায়ে পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে উত্তেজনা যখন চরমে তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান এবং মার্কিন বাহিনীকে কিউবার জলসীমা অভিমুখী সব জলযানে তল্লাশি চালানোর নির্দেশ দেন।

টান টান উত্তেজনায় ১৩ দিনের আলাপ-আলোচনার পর কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রও তুরস্ক থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেয় এবং কিউবায় হামলা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।

বিপ্লবের ফেরিওয়ালা : ১৯৬৫ সালে কাস্ত্রো কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নিজের দলকে একীভূত করেন, নিজে হন দলের প্রধান। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি আবির্ভূত হন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কট্টর সমালোচক হিসেবে। ১৯৬৬ সালে কাস্ত্রো এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে গড়ে তোলেন নানা সহায়ক প্রতিষ্ঠান। পরের বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন লাতিন আমেরিকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, যার হাত ধরে এর পরের কয়েক দশকে ওই অঞ্চলের অনেক দেশেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়।

১৯৭০-এর দশকে কাস্ত্রো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সোভিয়েত বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যেতে সামরিক সহায়তাও পাঠান। তাঁর পাঠানো সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া ও ইয়েমেনে। ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে সাহায্য করলেও বিভিন্ন দেশে সেনাসাহায্য পাঠাতে গিয়ে টান পড়ে কিউবার অর্থনীতিতে; পরে এ ধরনের অভিযান থেকে সরে আসেন কাস্ত্রো।

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তুলতেও বড় ভূমিকা ছিল কাস্ত্রোর। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলিঙ্গনের পর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান।’ ১৯৭৬ সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কাস্ত্রো।

কিউবাজুড়ে উন্নয়নের ছাপ : কাস্ত্রোর শাসনামলে কিউবায় শিক্ষা খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়। খোলা হয় অসংখ্য নতুন স্কুল। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া হয় দুর্গম অঞ্চলেও। ফলও মেলে হাতেনাতে, সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮ শতাংশে। কিউবায় শিক্ষা অবৈতনিক। শিক্ষিতের হার নিয়ে গর্ব করতেন কাস্ত্রো। বলতেন, ‘এমনকি আমার দেশের একজন যৌনকর্মীও আজ গ্র্যাজুয়েট।’

কাস্ত্রোর কিউবায় গড়ে তোলেন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা। সেখানে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে মাত্র ১১ জন। কিউবা গড়ে তুলেছে বিশ্বমানের চিকিৎসাব্যবস্থা, সব নাগরিক স্বাস্থ্যসেবা পায় বিনা মূল্যে। মাথাপিছু আয়ও ভালো।

ফের ধাক্কা, নতুন করে উঠে দাঁড়ানো : নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবার অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়। সোভিয়েতের দেশগুলোতেই সিগারেট ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করত কিউবানরা; ওই জোটের কাছ থেকে কম মূল্যে পেত তেল। সোভিয়েত জোটের কাছ থেকে বছরে ৪০০ কোটি ডলার অনুদান পেত কিউবা। এর মধ্যে তেল থেকে অস্ত্র—সবই থাকত।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেশে ধস ঠেকাতে নতুন পন্থা নেন কাস্ত্রো। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাপ দেওয়া শুরু করেন। এ সময় কিউবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুক্তবাজার অর্থনীতি পদ্ধতি চালু হয়। উৎসাহ দেওয়া হয় বিদেশি বিনিয়োগকেও। ডলারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সঙ্গে স্বল্প আকারে পর্যটনও চালু করা হয়। ১৯৯৬ সালে আবারও যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কাস্ত্রো। এ সময় দেশত্যাগী কিউবানদের নিজ দেশে ফিরে ব্যবসা ও বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান তিনি। হুগো শাভেজের আমলে ভেনিজুয়েলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল কিউবার।

অবশ্য ইতিমধ্যে স্বল্প পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে কিউবার। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও কিউবা সফর করেন। এর মাধ্যমে ৮৮ বছর পর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রথম কিউবায় পা রাখেন। যদিও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি কাস্ত্রোর। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দেওয়া সাহায্য নিতে চাননি কাস্ত্রো। বলেছেন, অনুদান নয়, কিছু দরকার হলে তাঁরা কিনে নেবেন।

সমালোচনাও মেলা : কাস্ত্রোর সমালোচকের সংখ্যা কম নয়। পশ্চিমারা তাঁকে ‘অধিকার হত্যাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তাঁর আমলে বন্ধ হয়েছে পেশাজীবী আন্দোলন, শ্রমিক ইউনিয়নের ধর্মঘট করার অধিকার। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি গণমাধ্যম, বিপাকে পড়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়ন এবং সেসব দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন, কারাদণ্ড, হত্যা ও দেশত্যাগে বাধ্য করারও অভিযোগ ছিল কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে।

চলে গেলেন আলো জ্বালিয়ে : এ বছর দুইবার প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল কাস্ত্রোকে। গত এপ্রিলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে ভাষণে তিনি নিজের শারীরিক অবস্থার কথা তুলে ধরে সমর্থকদের প্রস্তুত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আরেকবার আগস্টে জন্মদিনে।

মহান এ নেতার নামে কিউবায় কোনো সড়ক খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেখা মিলবে না তাঁর কোনো ভাস্কর্যেরও। তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কেও সব তথ্য স্পষ্ট নয়। তবে গায়ে জলপাই-রঙা উর্দি, চোয়ালভরা দাড়ি, আর মুখে ঝুলে থাকা হাভানা চুরুট—এ তিনের সমন্বয়ে কাস্ত্রোর যে চেহারা অনুসারীদের মনে স্থায়ীভাবে আঁকা হয়ে গেছে, তা থাকবে অমলিন।  তিনি থাকবেন দুনিয়াজুড়ে কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের নায়ক হয়ে। সাম্যবাদের আদর্শ হয়ে যুগে যুগে পথ দেখাবেন বিপ্লবীদের। সূত্র : কালের কন্ঠ।

Comment here