আন্তর্জাতিকরোহিঙ্গা সমাচার

মিয়ানমারে সহিংসতা : বাংলাদেশে ঢুকতে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করা হচ্ছে!

 

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ও টেকনাফ প্রতিনিধি

 teknaf-picপ্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সীমান্ত চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে সে দেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বেড়ে গেছে। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে রোহিঙ্গা মুসলমানশূন্য করার জন্যই সে দেশের সীমান্তরক্ষী পুলিশ ও সেনাবাহিনী এই কৌশল অবলম্বন করে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে রাখাইন থেকে আসা ২৭ সদস্যের একটি দলের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা হয়। রাখাইনের কেয়ারিপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মওলানা আবদুল গণি (৬২) স্ত্রী, দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়েসহ ২৭ জনের একটি দল নিয়ে শনিবার রাত আড়াইটার দিকে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে টেকনাফে এসে পৌঁছান। তাঁরা লেদা শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা রফিকের শেডে (বস্তি) আশ্রয় নিয়েছেন।

মওলানা আবদুল গণি কালের কণ্ঠকে বলেন, অক্টোবর মাসে সীমান্ত চৌকিতে হামলার ঘটনার পর থেকে তিনি যে মসজিদে ইমামতি করছিলেন সেখানে আর যেতে পারেননি। সেখানে সেনাদের অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত থাকায় প্রাণ বাঁচাতে এপারে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি জানান, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি নাফ নদের মিয়ানমারের কুমিরখালী এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমান। তিনি বলেন, এ জন্য মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী পুলিশকে জনপ্রতি ৩০ হাজার কিয়েট (মিয়ানমারের টাকা) অর্থাৎ বাংলাদেশি দুই হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। তাঁরা টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের তেচ্ছিব্রিজ এলাকা হয়ে অনুপ্রবেশ করেন। এখানকার দালালদেরও দিয়েছেন দুই হাজার টাকা।

এদিকে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্ট গার্ড ইতিমধ্যে শক্তি বাড়িয়েছে। তবে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে নাফ নদের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। তবে বিজিবি বলছে, কিছু কিছু হয়তো আসছে, ব্যাপক হারে নয়।

রাতের আঁধারে দালালের হাত ধরে এপারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানায়, গত মাসে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে একটি ব্যাটালিয়ন সদর ও চারটি সীমান্ত চৌকিসহ পাঁচটি স্থাপনায় একযোগে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চলে আসছে। রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর হামলা, ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে মিয়ানমারের সেনারা। এমনকি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সীমান্তে চলে যেতে বাধ্য করায় প্রাণ রক্ষার্থে অনেক নারী-পুরুষ নাফ নদের বিভিন্ন স্থান দিয়ে এপারে এসে আশ্রয় খুঁজছে।

এর মধ্যে মিয়ানমারের সেনারা রাখাইন রাজ্যে ৬৯ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। তবে তারা বলছে, নিহতরা হামলাকারী ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী।

জানা গেছে, টেকনাফ সীমান্তের হ্নীলার জাদীমুরা, লেদা, মুচনী, নয়াপাড়া, আলীখালী, দমদমিয়া, হ্নীলা ফুলেরডেইল, কাস্টমস ঘাট, হোয়াব্রাং, মৌলভীবাজার, খারাংখালী, নয়াবাজার, ঝিমংখালী, উনছিপ্রাং, লম্বাবিল, হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, নাজিরপাড়া, সাবরাং, মৌলভীপাড়া, বরইতলী, কেরুণতলীসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। ‘আদমঘাট পরিচালনায়’ নিয়োজিত দালালের মাধ্যমে মাথাপিছু দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তারা বাংলাদেশে ঢুকছে।

অনুপ্রবেশ করা এই রোহিঙ্গারা বর্তমানে টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অবস্থান নিয়েছে। এ ছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসা এবং প্রভাবশালী রোহিঙ্গাদের ঘরে অবস্থান নিচ্ছে বলে স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাইম্যাঘোনা এলাকার মৃত রফিক আহমদের ছেলে মৌলভী ছৈয়দ করিম ও কেয়ারীপাড়া এলাকার হাবিবুল্লাহ জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আত্মীয়স্বজনকে ধরে নিয়ে গুম এবং হত্যা করেছে। হত্যা, অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে পরিবার-পরিজন নিয়ে হোয়াইক্যং ঝিমংখালী এলাকা দিয়ে শনিবার মধ্য রাতে তাঁরা টেকনাফে চলে এসেছেন।

রাখাইনের জাম্বুনিয়া এলাকার কামাল হোছনের স্ত্রী নাজমা বেগম (৩০) বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনারা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে থাকা ৭ ও ৯ বছরের দুই ছেলেকে আমার সামনেই আগুনে নিক্ষেপ করেছে। তাই প্রাণভয়ে নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি।’

একই এলাকার হাবিবুল্লাহ নামের একজন বলেন, ‘গত শুক্রবার রাতে আমাদের গ্রাম থেকে কমপক্ষে দুই হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশের উদ্দেশে চলে আসে। তবে তাদের মধ্যে একসঙ্গে ঝিমংখালী সীমান্ত দিয়ে কয়েক শ জন টেকনাফ পার হয়ে এসেছি। বাকিরা কে কোথায় গেছে জানি না।’

রইগ্যদং এলাকার বদিউল আলমের মেয়ে নুর বেগম, শাহানুর ও মৃত হাছনের মেয়ে শরমিলা বেগম জানান, সেনারা তাঁদের বাড়িতে ঢুকে বাবা ও স্বামীদের ধরে নিয়ে যায়। খোঁজখবর নিয়ে তাদের না পেয়ে নিজেদের বাঁচাতে নাফ নদের লেদা সীমান্ত হয়ে রাতের আঁধারে টেকনাফে চলে এসেছেন।

তবে টেকনাফের বিজিবি ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ গণহারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন টেকনাফ এলাকায় ধান কাটার মৌসুম চলছে। সাধারণত এ সময় রোহিঙ্গারা এখানে ধান কাটার জন্য এসে থাকে। হয়তো বা কাজের খোঁজে কিছু রোহিঙ্গা আসছে এখানে, তবে ব্যাপক হারে নয়।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হয়তো বা সীমান্তের চোরাই পয়েন্ট দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা গোপনে অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারে। তবে ব্যাপক হারে নয়।’

Comment here