টেকনাফরোহিঙ্গা সমাচার

সবাইকে হারিয়ে রোহিঙ্গা শিশু সোহাইতের বাবার দিন কাটে চিল্লায়

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, টেকনাফ (কক্সবাজার ) 

সবাইকে হারিয়ে রোহিঙ্গা শিশু সোহাইতের বাবার দিন কাটে চিল্লায়

নৌকাডুবিতে প্রাণ হারানো শিশু সোহাইতের লাশ পড়ে আছে নাফ নদের চরে

মিয়ানমারের মংডু বড় গওজি বিলের জাফর আলম আজ সর্ব-স্বজনহারা। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে তিনি এখন রিক্ত ও নিঃস্ব।

স্বদেশে সেনা তাণ্ডবের মুখে জীবন বাঁচাতে পা বাড়ান বাংলাদেশে। পরে স্বজনদেরও নিজের কাছে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেসব স্বজন আজ তাঁর কাছে কেবলই স্মৃতি। সেনাদের গুলির মুখে নৌকা ডুবে নাফ নদে হারিয়ে গেছে তারা চিরতরে। ওদের মধ্যে ছিল জাফরের প্রাণপ্রিয় ছোট সন্তান সোহাইতও। নদের বালুচরে নিথর পড়ে থাকা যে ছোট্ট শিশুটির মৃতদেহের ছবি মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় ‘আয়লান কুর্দি’ নামে।কক্সবাজারের টেকনাফে লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সম্প্রতি কথা হয় জাফর আলমের সঙ্গে। স্বজনদের কথা বলতে গিয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন। দ্রুত গিয়ে নিয়ে আসেন দুই ছেলের লেমিনেট করা ছবি। স্বদেশে সেনা নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ওপরে হেলিকপ্টার ও নিচে মিলিটারি গুলি চালিয়েছে। দেশে থাকতে না পেরে চলে এসেছি গ্রাম ছেড়ে। পরে ওদেরকে রাইম্যাবিল থেকে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করি। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে দুটি নৌকা মিয়ানমার থেকে নাফ নদে ভাসে। একটি নৌকায় আমার স্ত্রী, দুই ছেলে, ওই নৌকায় আমার পরিবারের ছিল চারজন। এর মধ্যে আমার দুই ছেলে সোহাইত ও সোফাইত, স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম ছাড়াও শাশুড়ি নূর বেগম, আমার ভাই নূর ফয়েজ, আমার সম্বন্ধির সন্তান রোকেয়া, চাচাতো বোন ও তাঁর চার বাচ্চা ছিল। দুটি নৌকায় সব মিলিয়ে ৩৪ জন যাত্রী ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের মিলিটারিদের গুলির মুখে মাঝপথে দুটি নৌকাই ডুবে যায়। আমার সব হারিয়ে যায় নদীর পানিতে। ওই সব যাত্রীর মধ্যে মাত্র চারজন কোনোক্রমে বেঁচে যায়। পরে নাফ নদে নিখোঁজ ৩০ জনের মধ্যে মাত্র সাতজনের মৃতদেহ পাওয়া যায় বুড়া সিকদারপাড়ায়। আর আমার সোহাইতের নিথর দেহটা পাওয়া যায় নদীর চরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায়। এখন স্বজন বলতে আমরা তিন ভাইবোন আশ্রয়হীন অবস্থায় বেঁচে আছি। ’

নিজের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে ঝড়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে জাফর আলম এবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের দেশে এত মানুষ কুপাচ্ছে, মেরে ফেলছে, আটক করছে। আবার বাংলাদেশে আসতে চাইলেও গুলি করে নৌকা ডুবিয়ে দিচ্ছে। আমাদের অপরাধটা কী? আমরা পৃথিবীবাসীকে জানাতে চাই, আরাকানের রোহিঙ্গারা দুঃখে আছে। এর বিচার চাই। আমার শিশু বাচ্চাকে মেরে ফেলা হয়েছে—তাও দুনিয়াকে জানাতে চাই। ’

এক প্রশ্নের উত্তরে জাফর বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশেও ভালো নেই। থাকার ঘর নেই, খাওয়ার ভাত নেই। এখানে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছি। খাবার ও পানি পাচ্ছি। প্রাণে বেঁচে আছি এটুকুই। এখন শোক-দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে তাঁর সাহায্য চাই। তাবলিগ জামাতে শামিল হয়ে চিল্লায় দিন কাটাই। ’

রাখাইন ত্যাগ যে কারণে : বিভীষিকাময় দিনগুলোর উল্লেখ করে জাফর আলম বলতে থাকেন, ‘মিলিটারি রাতভর গুলি চালিয়েছে। একপর্যায়ে গ্রামের দক্ষিণ অংশে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় গ্রামের প্রায় সব মানুষ যে যার মতো করে পালিয়ে যায়। গ্রামে থেকে যাওয়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অসুস্থ ও জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকা লোকজনদের কেউ আগুনে পুড়ে মরেছে; কেউবা মরেছে গুলিতে। বিশেষ করে তরুণ সবলদের মিলিটারি সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমাদের মত তরুণ সবল মানুষকেও গুলি করে মেরেছে মিলিটারি। পরদিন সকালে ঘরে আমার চাচাকে ফোন করে জানতে চাই যে আমার পরিবার কোথায়। জানালেন যে তিনি জানেন না। এমনকি তার পরিবারের লোকজন কে কোথায় আছে তা-ও তাঁর জানা নেই। এভাবে খবর নিতে নিতে তিন দিন চলে যায়। জানা গেল, শতকরা পাঁচ ঘর এক জায়গায় থাকলেও ৯৫ ঘরের অবস্থাই আমাদের মতো। মা-বাবা-ছেলে কে কোথায় কেউ জানে না। কারণ মাটিতে দাঁড়িয়ে মিলিটারি গুলি চালিয়েছে। আবার ওপরে হেলিকপ্টার থেকেও সেনারা গুলি করেছে। ’

তিনি বলেন, পরিবারের অন্যদের খোঁজ না পেয়ে একপর্যায়ে অন্য অনেকের মতো ছোট ভাইকে নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হই। পাঁচ শ টাকা দরে এক হাজার টাকায় দুটি জেরিক্যান কিনি। জেরিক্যান দুটি নিয়ে রইংগ্যাদং ও রাইম্যাবিলের মাঝামাঝি লালদ্বীপে সাঁতরে পৌঁছি। জায়গাটা বাংলাদেশের সীমানার জাদিমোড়ার সামনাসামনি। লালদ্বীপে যাওয়ার পর জেলেদের হাত উঁচিয়ে ইশারা করি। পরে জেলেরা আমাদের বাংলাদেশের একটি চরে নামিয়ে দেয়। ’

নৌকাডুবিতে সব শেষ : জাফর আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে আসার পর পরিবারের অন্য সদস্যদের পার করানোর জন্য একজন ঘাইট্টা (নৌকাওয়ালা) ঠিক করি। টাকার লোভে ওই দিন নৌকাওয়ালা নৌকায় অতিরিক্ত মানুষ তোলে। আর রাতের অন্ধকারে মিলিটারি আন্দাজে গুলি ছুড়তে শুরু করলে আতঙ্কে নৌকার মধ্যে হুড়াহুড়ি শুরু হয়ে যায়। মিলিটারি টের পেয়ে তখন নৌকা লক্ষ করে একের পর এক গুলি ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে পাশাপাশি চলা দুটি নৌকাই ডুবে যায়। আমাকে একা ফেলে চিরতরে বিদায় নেয় আমার প্রিয় মানুষগুলো। ’

হতভাগা মানুষটি হাতে ধরা ছবির দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, ‘আমার আর কেউ নেই। বাচ্চা দুটিও শেষ, বিবিও শেষ। ছোটটির বয়স এক বছর পাঁচ মাস আর বড়টার তিন বছর ছয়-সাত মাস হবে। বড় ছেলেটা একটু শুকনা ছিল। আর ছোটটা গ্রামের সকলের আদরের ছিল। আল্লাহ খুব সুন্দর ছেলে দিয়েছিল। আমার সাথে বেশি খেলাধুলা করত। আমি করতাম দোকান, দোকান থেকে ঘরে আসামাত্র মায়ের কোল ছেড়ে আব্বা আব্বা বলে আমার কাছে চলে আসত। হামাগুড়ি দিতে পারত। সেই ছেলে নিয়ে এখন আর আমার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। চরের কাদায় অনাদরে পড়ে থাকা আমার সোহাইতের লাশের তিন কপি ছবি ওঠানো হয়, যা পরে ইন্টারনেটে দেওয়া হয়। এগুলোর এক কপি উপুড় হয়ে পড়ে থাকা, এক কপি চিত করে রাখা, আরেক কপি এক বৃদ্ধের ধরে রাখা। ছবিগুলো আমি দেখতে পারি না। সইতে পারি না এই কষ্ট। ’

নাগরিকত্ব দিলে ফিরে যাব : স্বজনহারা এই রোহিঙ্গা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের কমিউনিটির সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে, জ্বালাও-পোড়াও চলছে। সু চির সরকার ও বৌদ্ধরা বা ৯৬৯ গ্রুপ আরাকানে যাতে মুসলিমরা থাকতে না পারে তাই চাচ্ছে। ওরা বড় গওজি বিল, ছোট গওজি বিল, খোলা বিল, জামবনিয়া গ্রাম সম্পূর্ণ শেষ করে দিয়েছে। অনেক মানুষ মেরে ফেলেছে, পুড়িয়ে মেরেছে, তানাসুকে  (সেনা ঘাঁটি) ধরে নিয়ে গেছে। ’

অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো কিছু করেছেন এমন নজির নেই উল্লেখ করে জাফর বলেন, ‘মিলিটারির জেনারেল মেলাইং আর অং সান সু চি সারা বিশ্বের কাছে এসব অন্যায় অত্যাচারের কথা অস্বীকার করেই চলেছে। এর আগের সরকারও এ ধরনের ঘটনা বারবার অস্বীকার করত। অন্য দেশ ধরাধরি করলে তদন্ত করার জন্য এক বা দুই মাস সময় নিত। এভাবে এখনো সময় নিচ্ছে। আমি বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই, আপনারা এই সরকারকে আর সময় দেবেন না। আর অন্যদের মতো আমাদেরও সরকার নাগরিকত্ব দিলে দেশে ফিরে যাব। ’

প্রসঙ্গত, ওই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া চারজনের একজন জাফরের আত্মীয় রেহেনা। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার পর তাঁর কাছ থেকেই জানা যায় ওই রাতে মর্মান্তিক নৌকাডুবির খবর।

Comment here