আন্তর্জাতিকরোহিঙ্গা সমাচার

অজুহাত আরএসও

তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার ও জাবেদ ইকবাল, টেকনাফ

অজুহাত আরএসও

সেনা অভিযানে ক্ষতবিক্ষত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি এলাকার ধানক্ষেতে ত্রিপল টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গারা। ছবি : সংগৃহীত

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে (সাবেক আরাকান) কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন চলছে। নানা ছুতোয় প্রায়ই সেখানে অভিযান চালায় সরকারি বাহিনী। রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, সম্পদ লুট করে, নারীদের ধর্ষণ করে এবং নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায়। ওপারে সহিংসতা শুরু হলেই প্রাণে বাঁচতে নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের ঢল নামে।

ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাসহ সংশ্লিষ্টরা বলছে, রাখাইন অঞ্চলে অপতৎপরতা চালিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী রাখাইনে অভিযানে নামলে রোহিঙ্গারা বাড়িঘর ছেড়ে ভিড় করে বাংলাদেশ সীমান্তে। তখন তাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে বিদেশ থেকে তহবিল আদায় করে আরএসও। এভাবে বছরের পর বছর ধরে নিজেদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে তারা ষড়যন্ত্রের ঘুঁটি বানাচ্ছে রোহিঙ্গাদের। আর আরএসও দমনের অজুহাতে অসহায় রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে মিয়ানমার সরকার।

ওপারের পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তেও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির তৎপরতা চালাচ্ছে আরএসও। তাদের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জঙ্গি দলে ভেড়ানোর অভিযোগও রয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চলমান এ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল বুধবার ঢাকায় নিয়োজিত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অবিলম্বে সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে তাঁকে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল কক্সবাজারে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠক হয়েছে। তবে সীমান্তে কড়া নজরদারি সত্ত্বেও নাফ নদ পার হয়ে দালাল ধরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। এ নিয়ে গতকাল কালের কণ্ঠে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ও দালালচক্রের সদস্যদের আটক করতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। গতকাল সকালে উখিয়া ও টেকনাফ থানার পুলিশ ও বিজিবি অভিযান চালিয়ে চারজন দালালকে আটক করেছে। অনুপ্রবেশকারী ১৬৪ জন রোহিঙ্গাকেও আটক করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকটের নেপথ্যে আরএসও : গত ৯ অক্টোবর রাতে রাখাইন রাজ্যের উত্তর মংডু এলাকায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তিনটি চৌকিতে একযোগে হামলা হয় বলে দাবি করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তাদের ভাষ্য মতে, এতে বিজিপির ৯ সদস্য নিহত হয়। আহত হয় কয়েকজন। হামলাকারীরা ৬৩টি অস্ত্রসহ ১০ হাজারেরও বেশি গুলি লুট করে নিয়ে যায়।

রোহিঙ্গাসহ সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছে, সংকটে থাকা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা কেন বিজিপির চৌকিতে হামলা চালিয়ে অস্ত্র-গুলি লুট করতে যাবে?

সে ক্ষেত্রে ওই রাতে তাহলে সেখানে হামলা চালিয়েছিল কারা? মিয়ানমার সরকারও তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট করেনি এ প্রশ্নের জবাব। হামলার ঘটনার পর মিয়ানমারের সরকারি গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, বিদ্রোহী গোষ্ঠীরাই এ হামলার জন্য দায়ী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরে তদন্ত করে মিয়ানমার সরকার সেদিনের হামলার জন্য আরএসওকেই দায়ী করেছে।

হামলার ঘটনার পর অক্টোবরেই রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করে সরকারি বাহিনী। তবে তারা চূড়ান্ত অভিযান শুরু করে এক মাস পর, গত ১০ নভেম্বর থেকে। ‘প্রতিশোধ’ নিতে তারা রাখাইনের অন্তত ১৫টি গ্রামে ‘দুষ্কৃতকারীবিরোধী’ চিরুনি অভিযান শুরু করে। গতকাল কক্সবাজারে পতাকা বৈঠকে মিয়ানমারের বিজিপির উপমহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থোরা শান লুইন অভিযানের কথা স্বীকার করেন।

১৫ গ্রামে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান : ২৮ বছরের এক রোহিঙ্গা যুবক রাখাইন থেকে পালিয়ে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন গত সোমবার। নিজেকে কবির পরিচয় দিয়ে তিনি জানান, এটি তাঁর ছদ্মনাম। কারণ আসল নাম প্রকাশ করা হলে আর কোনো দিন দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না তাঁকে।

কবির জানান, তিনি রাতের বেলায় টানা চার ঘণ্টা সাঁতার কেটে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। সঙ্গে ছিল তাঁর একটি স্মার্ট মোবাইল ফোন। সেটিতে তিনি রাখাইনে দমন-পীড়নের চিত্র ধারণ করেছেন। সাঁতারের সময় পানি থেকে বাঁচাতে মোবাইল ফোনটিকে তিনি কয়েকটি পলিব্যাগে মুড়িয়ে নেন। তারপর পরনের লুঙ্গির সঙ্গে মোবাইল ফোনটি মাথায় বেঁধে নাফ নদে ঝাঁপ দেন। গত রবিবার রাত ১১টায় ওপারের রইঙ্গাধং নামক জায়গা দিয়ে তিনি নাফের নামেন পানিতে। সাঁতরে এপারে তিনি টেকনাফের লালদিয়ায় ওঠেন। তাঁর হাতে ছিল দুটি খালি জ্যারিকেন।

কবির এখন টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান নিয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। কবির বলতে থাকেন, আমার বাড়ি রাখাইনের ছোট গজিরবিল গ্রামে। গত ১০ নভেম্বর দিনের বেলায় হেলিকপ্টার থেকে গ্রামে অনবরত গুলি শুরু হয়, মারা যায় বহু রোহিঙ্গা। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বাঁচার জন্য আমরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাই। আমার স্ত্রী ও দুই সন্তান গেছে একদিকে, মা-বাবা গেছে আরেক দিকে। আর আমি আসছি এপারে।

কবির জানান, ছোট গজিরবিল ছাড়াও বড় গজিরবিল, হোয়াবেক, নাকফুরা, গোয়াখালী, বুড়া সিকদারপাড়া, বাইম্যা, কালিপ্রাণ, লংগদু, কুলাচিং, জামবইন্যা, বাহাইল্যাসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কমপক্ষে ১৫টি গ্রামে সেনাদের অপারেশন চলছে। এসব গ্রামের হাজারো রোহিঙ্গা পালিয়ে ধানক্ষেতসহ পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ এপারে (বাংলাদেশে) পালিয়ে আসছে। সেনারা বাছাই করে কেবল ওই ১৫ গ্রামেই অভিযান চালাচ্ছে। দমন-পীড়নের সময় সেনারা বলে, এসব গ্রামে লুকিয়ে থেকেই আরএসও সদস্যরা তাদের চৌকিতে হামলা করেছিল। এসব গ্রামের বাসিন্দারা হামলায় জড়িত বা আরএসওকে সহযোগিতা করেছে।

টেকনাফ রোহিঙ্গা শিবিরের আনসার ক্যাম্পের হামলা : গত ১৩ মে রাতে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের আনসার ক্যাম্পে ভয়াবহ হামলা হয়েছিল। হামলায় আনসার কমান্ডার হত্যার পর হামলাকারীরা ১১টি অস্ত্র ও ৬০০ গুলি লুট করেছিল। দীর্ঘদিনেও সেই লুণ্ঠিত অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। এ ঘটনার ব্যাপারে টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলায় সন্দেহজনক অনেককেই আটক করা হয়েছিল। মামলায় আটক একজন স্থানীয় বাসিন্দা ঘটনার ব্যাপারে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গাজিপাড়ার বাসিন্দা ছাবের আহমদের ছেলে নুরুল আবছার জবানবন্দিতে দাবি করেন, আরএসওর সক্রিয় সদস্যরাই পরিকল্পিতভাবে আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করেছে। লুটের ঘটনায় রাখাইন থেকেও আরএসও সদস্যরা এসে যোগ দিয়েছিল। এমনকি চট্টগ্রামে অবস্থান করা আরএসও সদস্যরাও হামলায় অংশ নিয়েছিল। আনসার ক্যাম্পের লুণ্ঠিত অস্ত্রও আরএসও সদস্যরা পাচার করে নিয়ে যায় রাখাইন রাজ্যে।

তবে জবানবন্দিতে নুরুল আবছার যেসব আরএসও সদস্যের হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা বলেছেন তাদেরও এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

টেকনাফের আনসার ক্যাম্পে হামলার কয়েক মাস পর গত অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যের সরকারি বাহিনীর চৌকিতে সশস্ত্র হামলার ঘটনায় সীমান্ত এলাকার লোকজনের মুখে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। তারা বলছে, মিয়ানমার বাহিনীর ওপর হামলা করার মতো আকস্মিক এত শক্তি আরএসও কিভাবে অর্জন করল?

রোহিঙ্গা শিবিরের বিকাশ মোবাইল : ৯ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকেই রোহিঙ্গাদের দলে দলে এপারে নিয়ে আসার জন্য ইন্ধন দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এ কাজে অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, দেশের বাইরে থেকেও বিকাশের মাধ্যমে টাকার জোগান দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সীমান্ত এলাকার লোকজন কালের কণ্ঠকে জানায়, টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে জামাল হোসেন নামের একজন বিকাশ এজেন্ট এ রকম লেনদেনে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জামাল মুসলিম এইড নামের একটি আন্তর্জাতিক এনজিওতে কাজ করতেন। টেকনাফে রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করার সময় জঙ্গিবাদের অভিযোগে তিন বছর আগে মুসলিম এইডকে সরকার টেকনাফে নিষিদ্ধ করে। এরপর থেকে জামাল বিকাশের এজেন্সি নিয়ে বসেন রোহিঙ্গা শিবিরে। তবে জামাল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আসলে এ রকম কাজ কারা কারা করে, তা একটু তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে।

জানা গেছে, রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের এপারে নিয়ে আসতে দালালচক্র টাকা পেয়ে থাকে বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমেই। কারণ যখন রাখাইনরা নির্যাতিত হয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে কোনো রকমে এপারে পালিয়ে আসছে তখন তারা দালালদের দেওয়ার জন্য টাকা পাবে কোথায়? এ ক্ষেত্রে বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের জন্য টাকার জোগান দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ শিবিরে বিকাশ এজেন্ট আমানুল্লাহ, আজগর আলী, পুতুসহ আরো অনেকেই রয়েছেন বিদেশ থেকে আসা বিকাশের টাকা যথাস্থানে জোগান দেওয়ার কাজে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনে ব্যক্তিগত বিকাশ অ্যাকাউন্টধারীরাও এ ক্ষেত্রে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে টেকনাফ থানার ওসি আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে গতকাল জানান, রোহিঙ্গা শিবিরের বিকাশ এজেন্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা খতিয়ে দেখবেন।

রাষ্ট্রদূতকে তলব, উদ্বেগ : বিডিনিউজ জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সহিংসতার শিকার হয়ে দেশ ছাড়ছে রোহিঙ্গারা। প্রাণ বাঁচাতে শত শত রোহিঙ্গা নাফ নদে নৌকায় ভাসছে, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে চাইছে তারা। এতে বাংলাদেশ সীমান্তে তৈরি হয়েছে নতুন সংকট। চলমান এ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল ঢাকায় নিয়োজিত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অবিলম্বে সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের তলবে গতকাল দুপুরে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেন। সেখানে তিনি অতিরিক্ত সচিব কামরুল আহসানের সঙ্গে দেখা করেন।

কামরুল আহসান পরে সাংবাদিকদের বলেন, যে পরিস্থিতি চলছে তা নিয়ে ‘বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা’ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে আসা মিয়ানমারের শরণার্থীরা যাতে ফিরে যেতে পারে সে জন্য পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে আহ্বান জানানো হয়েছে।

পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক পরে সাংবাদিকদের বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া হবে।

পতাকা বৈঠক : চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির মধ্যে গতকাল সৌজন্য পতাকা বৈঠক হয়েছে। কক্সবাজার শহরের বিজিবি রেস্ট হাউসে সকালে এ বৈঠক হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের ১২ সদস্যের দলের নেতৃত্ব দেন বিজিবির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোন্দকার ফরিদ হাসান। বিজিপির ১৩ সদস্যের দলের নেতৃত্ব দেন সংস্থার উপমহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থোরা শান লুইন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে বিজিপি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, রাখাইনে গত অক্টোবরের সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে চিরুনি অভিযান চলছে। অভিযানের কারণে রাখাইন রাজ্যের কিছু বাসিন্দা হয়তো নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরা শান লুইন আশাবাদী যে পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোন্দকার ফরিদ হাসান বলেছেন, ‘সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে সরকার জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে। বিজিবি কোনোভাবেই সীমান্ত  দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করতে দেবে না।’ সীমান্তে দালালদের তৎপরতার কথা স্বীকার করে তিনি জানান, নাফ নদের দুই পারেই দালালরা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে।

খোন্দকার ফরিদ হাসান দালালদের বিষয়ে বলেন, ওপারের লোকজন এপারের প্রকৃত অবস্থা জানে না। এপার আর ওপারের একশ্রেণির দালালের সহায়তায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে। এ জন্য দুই পারে দালালদের জনপ্রতি তিন হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের নাগরিকরা যাতে বাংলাদেশে না আসে সে ব্যাপারে বিজিপি সজাগ দৃষ্টি রাখছে বলে আমাদের জানিয়েছেন। এ অবস্থা নিরসনে বিজিবি-বিজিপি সমন্বিত টহল পরিচালনার মাধ্যমে সীমান্ত সন্ত্রাস কমিয়ে আনার ব্যাপারে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে।’ রোহিঙ্গা ইস্যুটি কূটনৈতিক পর্যায়ে সুরাহা করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

গতকাল বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার ও বিজিবি ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, সীমান্তে সার্বক্ষণিক টহল আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। দিনের চেয়ে রাতের বেলায় রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশে বেশি তৎপর হয়। এ কারণে বিজিবি রাতের বেলা বাড়তি সতর্ক থাকছে।

চার দালাল, ১৬৪ রোহিঙ্গা আটক : সীমান্তে কড়া নজরদারি সত্ত্বেও নাফ নদ পার হয়ে দালাল ধরে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। তারা বলছে, টাকার বিনিময়ে রাতের বেলায় তাদের টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে দালালরা। স্থানীয়রা বলছে, এ কাজে সীমান্তে শতাধিক দালালচক্র সক্রিয়। এ নিয়ে গতকাল কালের কণ্ঠে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অবশেষে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ও দালালচক্রের সদস্যদের আটক করতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। গতকাল সকালে উখিয়া ও টেকনাফ থানার পুলিশ এবং বিজিবি অভিযান চালিয়ে চার দালালকে আটক করেছে। অনুপ্রবেশকারী ১৬৪ জন রোহিঙ্গাকেও আটক করা হয়েছে।

বিজিবি টেকনাফ সীমান্তে আটক করেছে ৯৪ রোহিঙ্গাকে। উখিয়া থানার পুলিশ দুই দালালসহ ৬২ জন এবং টেকনাফ থানার পুলিশ আটক করেছে দুই দালালসহ ১০ রোহিঙ্গাকে। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের থাইংখালী, বালুখালী; টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং ও হ্নীলা এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়।

আটক দালালরা হলো থাইংখালী এলাকার মোহাম্মদ সরওয়ার (১৮), কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ রফিক (২৯), হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরা এলাকার ওসমান গণি (৩২) ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বাবিল এলাকার শাহ আলম (২৭)।

উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন, সকালে থাইংখালী সীমান্ত দিয়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে ঝোপ-জঙ্গলে আত্মগোপন করে। খবর পেয়ে পুলিশ পালংখালীর থাইংখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬২ রোহিঙ্গা ও দুই দালালকে আটক করে। টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢোকায় দালালরা।

টেকনাফ থানার ওসি মো. আবদুুল মজিদ বলেন, গতকাল ভোর রাতে সীমান্তের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং এলাকায় অভিযানে একটি ঝুপড়ি ঘরে আত্মগোপন করা অবস্থায় আটজন রোহিঙ্গা ও দুই দালালকে আটক করা হয়েছে।

মিয়ানমার সীমান্তে গুলি : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদের ওপারে মঙ্গলবার রাতভর গুলি হয়েছে। এপার থেকেও তার শব্দ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় লোকজন। গতকাল সকালে এপারে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, নাফ নদের তীরের নাইচদং, রাইম্যাখালী ও কোয়ানচিবং বিজিপি বিওপি থেকেই গুলি করা হয়েছে। নাইচদং বিজিপি বিওপির দুই সদস্য পার্শ্ববর্তী তিন রোহিঙ্গা নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুলির ঘটনা ঘটে।

আগে দেশের মানুষ, পরে অন্যদের মানবাধিকার : গাজীপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেওয়ার ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, ‘কাগজে-কলমে বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা থাকলেও অনেকের হিসাবে এ সংখ্যা চার-পাঁচ লাখ। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং নানা অপরাধমূলক কাজ করছে। অনেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে বাংলাদেশের বদনাম করছে। তাই আমাদের দেশের মানুষের মানবাধিকার আগে দেখতে হবে। পরে অন্যদের।’ গতকাল দুপুরে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে কিশোরী উন্নয়নকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ :  ঢাকার নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বাংলাদেশকে আরো কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে মিয়ানমারকে একঘরে করার উদ্যোগ গ্রহণ ও শরণার্থীদের রক্ষার দাবিতে গতকাল রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে গণসংহতি আন্দোলন।

আর রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যালার্ট নামে আইনজীবীদের আরেকটি সংগঠন পৃথকভাবে মানববন্ধন করেছে। ২৭ নভেম্বর আবারও মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে সমিতি।

প্রসঙ্গত, গত ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এরপর ওই রাজ্যে সেনা পাঠায় মিয়ানমার সরকার। সেনা অভিযানে গত কয়েক দিনে ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে। তবে তারা দাবি করেছে, নিহতদের মধ্যে ৬৯ জন সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, বাস্তবে নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। রোহিঙ্গারাও বলছে, নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি হবে। সেনা অভিযানে এক হাজার ২০০-এর বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণসহ সেখানে নানা নির্যাতন চলছে।

Comment here