জাতীয়সংস্কৃতি

‘গোল্ডেন বয়েজ থেকে এলআরবি’ একজন রবিনের ‘এবি’ হয়ে ওঠার গল্প

 

  • শামসুল ইসলাম, চট্টগ্রাম
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর এনায়েতবাজারে তার জন্ম। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় আইয়ুব বাচ্চু। এক ছেলে এক মেয়ের জনক তিনি। জামালখানস্থ সেন্ট মেরীস স্কুল দিয়েই শুরু তার শিক্ষাজীবন। সেখান থেকে সরকারী মুসলিম হাইস্কুলে। বরাবরই ক্লাশে ভালো ফলাফল করতেন। গানের প্রতি তার ঝোঁক থেকে সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালেই বাবা গিটার কিনে দেন তাকে। গিটার হাতে পেয়েই বেড়ে যায় তার উৎসাহ। নিজেকে জড়িয়ে নেন সঙ্গীতের সঙ্গে। বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন মিউজিক দারুনভাবে আকৃষ্ট করে তোলে তাকে। স্কুলজীবনেই বন্ধুদের নিয়ে দলবেঁধে বিভিন্ন গান গাইতেন খালি গলায়। স্কুল জীবন পেরিয়ে কলেজে পা রেখেই গঠন করেন ব্যন্ড দল ‘গোল্ডেন বয়েজ’। বিয়ে, জন্মদিন, স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান করতো এই গোল্ডেন বয়েজ। পরবর্তীতে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। মাঝখানে চট্টগ্রামের অন্যতম ব্যান্ড দল ‘ফিলিংস’ এর সঙ্গে দেড় বছর কাজ করেন। ১৯৮০ সালে ‘ ফিলিংস’ ছেড়ে যোগ দেন ‘সোলস’-এ। একটানা দশ বছর লিড গিটারিস্ট এর দায়িত্ব পালন করেন সেখানে। ১৯৯১ সালে নিজেই গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড দল ‘এলআরবি’। ১৯৯২ সালে প্রথম অডিও এ্যালবাম ‘এলআরবি’ বের হবার পর ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একের পর এক এ্যালবাম প্রকাশ আর দেশ-বিদেশে স্টেজ শো’র মাধ্যমে খ্যাতির শিকড়ে ওঠে যান আইয়ুব বাচ্চু। নিজেকে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশের বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের কিংবদন্তী গিটারিস্ট হিসাবে।

চট্টগ্রামের উদীয়মান ব্যন্ড শিল্পীদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে গত আগস্ট মাস থেকে নগরীর নাসিরাবাদ এলাকায় শুরু করেছিলেন ‘এবি লাউঞ্জ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতি শনিবার রাতে চট্টগ্রামের তরুণ শিল্পীরা পারফরমেন্স করেন এই লাউঞ্জে। প্রতিটি পারফরমেন্সে ঢাকা থেকে অনলাইনে সংযুক্ত থাকতেন আইয়ুব বাচ্চু নিজেই। এবি লাউঞ্জ উদ্বোধনকালে বাচ্চু বলেছিলেন, চট্টগ্রামের উদীয়মান শিল্পীদের জন্য আমি একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দিয়ে যেতে চাই। সেই লক্ষ্যে ‘এবি লাউঞ্জ’র প্রতিষ্ঠা।

আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হবার পর নগরীর এনায়েতবাজারে আইয়ুব বাচ্চুর বাড়িতেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তার পুরোনো বন্ধু ও ভক্তরা ভিড় করছেন সেখানে। বাসায় চেয়ারে বসে নীরবে অশ্রু ফেলছেন বাচ্চুর শোকার্ত পিতা ব্যবসায়ী মো. ইসহাক। কিছুক্ষণ পর পর শুধু বলে ওঠছিলেন- ‘আমাকে ফেলে কীভাবে অকালে চলে গেলো আমার বুকের ধন’।

সেখানে উপস্থিত আইয়ুব বাচ্চুর স্কুল জীবনের বন্ধু ও ফুফাত ভাই ব্যাংকার পারভেজ রিফাত আহমেদ জানান, মুসলিম হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে থাকাবস্থাতেই গিটারে হাতে খড়ি বাচ্চুর। নবম শ্রেণীতে পড়াকালে পুরোপুরি গিটারে মগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। আপন চাচাত ভাই তাহেরের বিয়েতে প্রথম গিটার নিয়ে গান পরিবেশন করেন বাচ্চু। এরপর থেকে বিভিন্ন বিয়ে অনুষ্ঠান, স্কুলের কালাচারাল প্রোগ্রাম ইত্যাদিতে গান করে প্রশংসা কুড়ান তিনি।

নগরীর লালখান বাজার এলাকার ওস্তাদ জেকব ডায়েসের কাছ থেকে বেসুরা শিল্পী গোস্টির সদস্য হিসাবে গিটার শিখেন বাচ্চু। নিজের শিষ্য সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, স্কুলে পড়া অবস্থায় স্টেডিয়ামস্থ দারুল কাবাবের সামনে খালি জায়গায় ছিল তাদেও আড্ডা । সেখানে কেউ গিটার বাজাতেন, কেউ গান গাইতেন। বাচ্চুও তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। আইয়ুব বাচ্চু সম্পর্কে মূল্যায়ণ করতে গিয়ে জেকব বলেন, ‘আমার ছাত্রদের মধ্যে বাচ্চুর মেধা ছিল অন্যরকম। কোন কিছু দেখলেই শিখে নেয়ার মতো অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তার। বাচ্চুর মৃত্যুতে আক্ষেপ ব্যক্ত কওে বাহাত্তর বছর বয়স্ক জেকব বলেন, ‘আমারই তো আগে চলে যাবার কথা ছিল পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। কিন্তু আমার শিষ্য আমার আগেই চলে গেলেন।’

বাচ্চুর পারিবারিক সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসা হবে তার মরদেহ। এখানে জানাযা শেষে চৈতন্য গলি কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশেই সমাহিত করা হবে তাকে।

Comment here