রোহিঙ্গা সমাচার

নাফ নদে ফের নৌকাডুবি : দুই রোহিঙ্গা শিশু ও নারীর লাশ উদ্ধার

 

তোফায়েল আহমেদ, কক্সবাজার, এস এম রানা, চট্টগ্রাম ও জাবেদ ইকবাল, টেকনাফ   

15390939_1325408887500188_6579049591266143753_nসেনাবাহিনীর ধারাবাহিক তাণ্ডবের শিকার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। রাতের আঁধারে সীমান্তে পাহারারত বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে আসছে রোহিঙ্গা শিশু-নারী-পুরুষের দল।

পালিয়ে আসার পথে অন্তত ৩৫ জন রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষবাহী একটি নৌকা ডুবে গেছে নাফ নদে। গত রবিবার রাত ১০টার পর নাফ নদের রৈংগ্যাদাং ঘাট থেকে নৌকাটি বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে কয়েক শ গজ সামনে আসার পর আকস্মিক উল্টে যায়। আরোহীদের কেউ কেউ সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও শিশুসহ অনেকের সলিলসমাধি হয়েছে।নৌকাডুবির ঘটনার পরদিন গতকাল সোমবার সকালে মাছ ধরার এক নৌকার মাঝির সহায়তায় রেহেনা বেগম (২২) নামের এক নারী বাংলাদেশে পৌঁছে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তবে টেকনাফে বিজিবি কর্তৃপক্ষ নৌকাডুবির ঘটনাটি ‘কল্পকাহিনী’ বলে দাবি করেছে।

ওদিকে নাফ নদের ওপারে বুড়া সিকদারপাড়া এলাকা থেকে দুই শিশু ও এক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে স্থানীয় লোকজন। গতকাল দুপুরে নৌকাডুবির ঘটনাস্থল থেকে দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার ভাটিতে এসব লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই তিন লাশের ছবি কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে। নাফ নদ থেকে উদ্ধার হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে রেহেনা বেগম কালের কণ্ঠকে মৃতদের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। রাত সাড়ে ৮টায় কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি ছবিগুলো শনাক্ত করেন। রেহেনার শনাক্ত মতে, উদ্ধারকৃত বৃদ্ধার নাম নূর বেগম। তিনি রেহেনার মায়ের খালা। স্বামীর নাম মৃত আলী হোসেন। তিনি বড় গওজিবিল এলাকার বাসিন্দা। আর নিহত শিশুর মধ্যে মোহাম্মদ তোহাইদ (আনুমানিক দেড় বছর) মৃত নূর

বেগমের নাতি। শিশুটির বাবার নাম মোহাম্মদ জাফর। মায়ের নাম ছেনু আরা। দাদির সঙ্গে শিশু তোহাইদ নৌকায় ছিল বলে রেহেনা দাবি করেন।

উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে আরেক শিশুর নাম মোহাম্মদ সোহাইব। সে রেহেনার ভাতিজা। সোহাইবের বাবার নাম ইজ্জত আলী। তাঁকে ১৩ নভেম্বরের পর পুড়িয়ে হত্যা করে সেনা সদস্যরা। আর মা মনিরা শিশুসন্তানকে নিয়ে নৌকায় ছিলেন। মনিরা নিখোঁজ রয়েছেন। অন্য শিশুটির নাম ছাবের। তার বাবার নাম ছৈয়দ সালাম। ওই শিশুটিও বড় গওবিল এলাকার বাসিন্দা।

এ ছাড়া ওপারে নাফ নদের তীরে বুড়ি সিকদারপাড়ার বাসিন্দারা আরো ছয়টি লাশ উদ্ধারের তথ্য জানিয়েছে।

ছবি ছাড়াও একটি ভিডিও ফুটেজ কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে। ভিডিও ফুটেজে বলা হচ্ছে, ‘নৌকা নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় নৌকাডুবির ঘটনায় ১২ জন বয়স্ক মারা গেছেন বলে শোনা গেছে। এ ছাড়া কয়েকটি শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে বুড়া সিকদারপাড়া এলাকায় দুটি শিশুর লাশ ভেসে আসে। নদ থেকে শিশুদের লাশ আমরা তুলেছি। লাশ ধুয়ে এখানে দাফনের জন্য রাখা হয়েছে। কেউ যদি এই দুই শিশু চিনতে পারে, তাহলে খবর দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার কারণে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে লাশ দুটি দাফন করা হবে। কোনো আত্মীয় যদি বুড়া সিকদারপাড়ায় আসে, তাহলে ভালো হয়। ’

উদ্ধারকৃত এক বয়স্ক নারীর লাশের পরিচয়ও পায়নি বুড়া সিকদারপাড়ার বাসিন্দারা। তবে বাংলাদেশে উদ্ধারকৃত রেহেনা শুনেছেন, তাঁর মা ও ভাতিজার লাশ উদ্ধার হয়েছে। লাশগুলো দাফনের ব্যবস্থা হচ্ছে ওপারে। আর কালের কণ্ঠ’র কাছে দুই শিশুসহ তিনটি সাদা কফিন পরানো মরদেহের ছবি ওপার থেকে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল আবু জার আল জাহিদ বলেন, ‘রেহেনা বেগমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে বোঝা গেছে যে নৌকাডুবির ঘটনাটি বানানো। ওই নারী প্রথমে লালদিয়া ও পরে জলিলেরদিয়ায় অবস্থান করেন। একপর্যায়ে জেলেদের নৌকা দেখে রোহিঙ্গা নারী নাফ নদে ভাসছে এমন অভিনয় করে চিৎকার করতে থাকেন। জেলেরা চিৎকার শুনে ওই নারীকে কূলে নিয়ে আসে। এপারে আসার পর তিনি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে আত্মীয়র বাড়িতে ওঠেন। ’

নৌকাডুবির ঘটনায় উদ্ধার পাওয়া রেহেনা কালের কণ্ঠ’র কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি মিয়ানমারের মংডু বড় গওজিবিল এলাকার মৌলানা মোহাম্মদ আমিনের স্ত্রী। রেহেনার ভাষ্য মতে, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশায় রবিবার রাত আনুমানিক ১০টার দিকে অন্য অনেকের সঙ্গে তিনি মিয়ানমারে নাফ নদের রৈংগ্যাদং ঘাটে অবস্থান নেন। কিছু সময় পর বাংলাদেশ থেকে নৌকা নিয়ে ঘাটে পৌঁছে বাংলাদেশি চার দালাল। দালালরা জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে নিয়ে অন্তত ৩৫ জন শিশু, নারী ও পুরুষকে নৌকায় তোলে। ওই নৌকায় তাঁর মা বিলকিস, ভাবি মনিরা, আট বছরের ভাইপো সোয়াইব ও ছয় বছর বয়সী ভাইঝি নুর আয়েশাও ছিল। নৌকাটি নাফ নদে আধা কিলোমিটার এগোনোর পর হঠাৎ ডুবে যায়। ডুবে যাওয়ার প্রাক্কালে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে তিনিও নাফ নদে ঝাঁপ দেন। রাতে সাঁতার কাটতে কাটতে একপর্যায়ে একটি দ্বীপের সন্ধান পান। ওই দ্বীপেই তিনি রাত পার করেন। সোমবার সকালে নাফ নদে জেলেদের নৌকা দেখে তিনি চিৎকার দেন। তাঁর চিৎকার শুনে জেলেরা রেহেনাকে নৌকায় নিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোড়া ও নয়াপাড়ার মাঝামাঝি স্থানে নামিয়ে দেয়।

হ্নীলা পৌঁছার পর রেহেনা তাঁর আত্মীয় কবির আহমদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই বাড়িতেই গতকাল সকালে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে রেহেনার কথা হয়। এই নারী আরো জানান, ১০-১২ দিন আগে তাঁর স্বামী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এরপর তাঁরাও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টায় ছিলেন।

রেহেনা বলেন, মাঝি তথা দালালরা টাকার লোভে অতিরিক্ত মানুষ তোলার কারণেই নৌকাটি ডুবে যায়। ওই ঘটনায় তাঁর এক বোন, মা ও ভাইপোর লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। তাঁর ভাবি নিখোঁজ রয়েছেন।

রেহেনা বেগম সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে বিজিবির একটি দল কবির আহমদের বাড়িতে পৌঁছে। তাঁরা রেহেনাকে উদ্ধার করে টেকনাফ লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছে দেন। এরপর রোহিঙ্গা শিবিরের আইওএম পরিচালিত হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রবিবার রাতে ওপারের রইগ্যাদং থেকে জাদিমোরা পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের আনতে নৌকা নিয়ে যান বাংলাদেশি দালাল ইসমাইল, আরফাত, সালাম প্রকাশ বলী গুইজ্যাসহ চারজন। তাঁরা জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে নিয়ে অন্তত ৩৫ জনকে নৌকায় তোলেন। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে নৌকাটি নাফ নদে ডুবে যায়।

জবাইয়ের শিকার শিশুসন্তানের লাশ ফেলে পালিয়ে এসেছেন শামসুল আলম : মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করে গতকাল সন্ধ্যায় উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছেন শামসুল আলম (৩৫)। তিনি মংডুর শীলখালী নয়াপাড়া এলাকার আমির হোসেনের ছেলে। কুতুপালং ক্যাম্পে বসে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমার পাঁচ বছরের ছেলে মোহাম্মদ জোহারকে গলা কেটে হত্যা করেছে বর্মী বাহিনী। এ ছাড়া পাড়ার নারীদের গণধর্ষণ করা হয়েছে। ’

শামসুল আলম জানান, দুই শিশুসন্তানসহ সাতজনকে নিয়ে গতকাল দুপুরে তিনি এপারে পালিয়ে আসেন। সন্ধ্যায় তিনি পৌঁছেন কুতুপালং ক্যাম্পে। কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ওপারে শীলখালীর নয়াপাড়া ঘেরাও করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ভোরে পাড়া ঘেরাওয়ের পর অনেকেই পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। পালানোর সময় তাঁর পাঁচ বছরের শিশু জোহার সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে। তাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। জবাই করা সন্তানের লাশটাও দাফন করতে পারেননি তিনি। তাঁর সঙ্গে এসেছে ছেলে জুবায়ের (১০), ভাইপো জাবের (১২), ভাই মমতাজুল হক (২২), ভাগ্নে জুবায়ের (১৩), ভাইপো তাফায়েল (৮) ও মোবারক (৮)। এখনো তিন সন্তান ওপারে রয়ে গেছে।

শামসুল বলেন, ‘নয়াপাড়া এলাকায় নারীদের এক স্থানে জড়ো করে রাখা হয়েছে। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানি না। আমার জানা মতে, রবিবার রাত ও ভোরে ১৪-১৫ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে অনেকেই। নারীদের গণধর্ষণ করা হচ্ছে। অনেক নারী ভয়ে কুমারখালী এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তারাও বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। ৮-১০ বছরের শিশু বা তার বেশি বয়সের পুরুষ কেউ আর পাড়ায় নেই। এ কারণে নিহতদের দাফন করা যাচ্ছে না। এখানে-সেখানে লাশগুলো পড়ে আছে। ’

রোহিঙ্গা বোঝাই চার নৌকা মিয়ানমারে ফেরত : রোহিঙ্গা বোঝাই চারটি নৌকা নাফ নদ থেকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। প্রতিটি নৌকায় ১০-১২ জন করে নারী-পুরুষ ও শিশু ছিল বলে জানায় বিজিবি। রবিবার রাত থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত এসব নৌকা আটক করে ফেরত পাঠানো হয়।

টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল ছিদ্দিকী সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদার রয়েছে।

নাফ নদ থেকে নৌকা ও জাল নিয়ে গেছে বিজিপি : নাফ নদ থেকে জালসহ একটি নৌকা নিয়ে গেছে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। এ সময় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে কূলে ফিরে আসে তিন জেলে। জানা যায়, বড়ইতলী গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে জামাল হোসেন, জমিল হোসেনের ছেলে দিলদার হোসেন ও ইউনুছের ছেলে আবু ছিদ্দিক গতকাল সকাল ৯টার দিকে নাফ নদের জলিলের দ্বীপ ও ছোয়ারদিয়ার এলাকার মাঝামাঝি পানিতে বাটা জাল পোঁতেন। সকাল ১১টার দিকে বিজিপির একটি স্পিডবোট তাঁদের নৌকায় ধাক্কা দেয়। তাঁরা তিনজন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়ে আসেন।

Comment here