এক্সক্লুসিভ

একটি বাড়িই যখন আপনার পারিবারিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস!


মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি
:

নারীদের গায়ের রঙের মতো নিজের একটা বাড়ি থাকাও একটা পারিবারিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস আমাদের সমাজে। এই যে যেমন, একটা মেয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অন্যান্য গুন যতই থাকুক না কেন , গায়ের রঙ একটু কালো হলেই শুনতে হয়,’’ হ্যাঁ মেয়েটার সবই ঠিক আছে কিন্তু মেয়েটা কালো।’’ অর্থাৎ মেয়েটার গায়ের রঙ তার মন-মানসিকতা এবং তাঁর অর্জিত সব যোগ্যতা থেকেও উর্দ্ধে , তার বুদ্ধিমত্তা, গুন সবই মলিন ঐ গায়ের রঙের কাছে। ঠিক তেমনি কেউ যদি দেশের বাইরে অনেক বছর থাকে বাঙালী/ উপমহাদেশের সমাজে তার স্ট্যাটাস নির্ধারণ করা হবে, সেই মানুষটি বিদেশের মাটিতে কোন বাড়ি করতে পারলো কিনা। বিদেশের মাটিতে প্রতিদিন যুদ্ধ করে টিকে থাকা, নিজের একটা অবস্থান তৈরি করা, কিংবা ভালো চাকরী বা শিক্ষাগত যোগ্যতা সবই কেমন যেনো তাদের কাছে ফিকে হয়ে যায়, উয্য হয়ে যায়। ‘’ কি মিয়া, এতো বছর বিদেশে থাইক্কা একটা বাড়িও করতে পারলানা? কি করলা সারাটা জীবন?’’ শুধুই কি প্রবাসে থাকা মানুষদের শুনতে হয়? আমি সিউর দেশের মানুষদেরও শুনতে হয়, স্ট্যাটাস এর কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে দেয় সেই মানুষটিকে মুহূর্তেই।

আরে, আমিই তো এই বক্সের দারুন উদাহরণ , একে তো গায়ের রঙ ময়লা, তার উপর বাড়িও করি নাই। সুতরাং আমার সব অর্জন হলো জিরো , আর স্ট্যাটাস হলো মাইনাস। শুনতে অবাক হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটাই কিন্তু বাস্তব চিত্র, এগুলোই শুনতে হয় আমাকে, আমাদের মতো মানুষদের। কি হয়না ?

আমি জানি , একটা বাড়ি মানে একটা ঘর, যেখানে ঐ ঘরের সদস্যদের সুখ-দুঃখগুলো স্মৃতির চাদরে মোড়ানো থাকে। একটা বাড়ি মানে জীবনের একটা সিকিউরিটি, বিপদের সঙ্গী কারণ বিপদ তো আর বলে কয়ে আসে না।
জন্মের পর থেকে দেখেছি ঢাকার কেন্দ্র বিন্দু তে বাবার ২/৩ টা বাড়ি। সেই ১৯৪০ সাল থেকে বাবা নিজের আস্থানা করেছিলেন তেজগাঁও এলাকায়। সবাই আমাকে/আমাদের বাড়ীওয়ালার ছেলে/মেয়ে বলে সম্বোধন করতো। আজ থেকে ২৫/৩০ বছর আগে বাড়িওয়ালার ছেলে বা মেয়ে এমন ডাকে মনে হয় কোন Power ভাব ছিলো; মানে হয়তো, কেমন যেনো সম্মান ভাব ছিলো কারণ ভাইদের বা অন্যান্য বাড়ীওয়ালার সন্তানদের দেখতাম ঐ বাপের বাড়ীর অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়তো না। কিন্তু আমাদের বাবার বাড়ি দিয়ে বাইরে ফুটানি দেখানো বাড়িগুলো ফুরুত করে হয়ে যায়নি। বাবার তিল তিল করে সৎভাবে কষ্টার্জিত আয় থেকে বাড়ি করা, নিজের জানের প্রতি তোয়াক্কা না করে, বিলাসিতা না করে, ঐ বাড়িগুলো করেন নিজের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার জন্য। অথচ তিনি (বাবা) নিজে ভোগ করে যেতে পারেননি। যখন সব তৈরি করে উনার আরাম করার সময় হলো তখনই উনার ওপার থেকে ডাক আসলো , চলে যেতে হলো। হয়তো একারনেই আমার কখনোই নিজের বাড়ি করার চালনা আসেনি।(উল্লেখ্য, মা চেয়েছিলেন দেশের মাটিতে নিজের উপার্জিত আয় দিয়ে কোন সম্পদ করি, মায়ের কথা রেখেছিলাম এবং রাখতে গিয়ে অনেক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার শিকার হলাম, তা নিয়ে আগেই অনেক কথা বলা হয়ে গিয়েছে।)

এরপর প্রবাসের জীবনেও ঐ বাড়ি পিছনে দৌড়ানোর খায়েশ জন্মায়নি আর। একটা বাড়ি করতে নিজের জীবনের সাথে যেই কম্প্রোমাইজ/ সেক্রিফাইজ করতে হয় , তা করতে আমি রাজি নই। মনে হয়, কি হবে নিজের জান আর জীবনকে এতো কষ্ট দিয়ে, হুট করে তো একদিন চলেই যাবো। যা করেছি বা করতে চেয়েছি, তা হলো শুধুমাত্র নিজের উপর ইনভেস্ট করা, নিজেকে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে আবিষ্কার করা , নিজেকে সমৃদ্ধ করা। এটি হতে পারে আমার ব্যাক্তিগত উদাসীনতা এই পার্টিকুলার ব্যাপারে।
বিদেশের মাটিতে বাড়ি করতে পারিনি বলে পারিবারিক ভাবে আমার স্ট্যাটাস অনেক নীচে , হাহাহাহা । তাদের প্রশ্ন, কি করলাম এতো বছর বিদেশে থেকে, একটা নিজের বাড়িও করতে পারলাম না? তাদের কাছে আমার কোন অর্জন চোখে পড়ে না বা আমার একা যেই দুই সন্তানের বড় করার দায়িত্ব আমার ঘাড়ে সেইটাও চোখে পড়ে না। ঐ যে, একজনের স্ট্যাটাস পরিমাপ করা হয় একটা বাড়ি দিয়ে।
অনেকেই প্রশ্ন করতেই পারেন, মরেই যেহেতু যাবেন তাহলে এতো অর্জন করা/ সাফল্য পাওয়ার পিছনে দৌড়ান কেনো? জানেন, একটা বাড়ি আপনাকে চিন্তাশক্তি উন্মুক্ত করে না, আপনাকে দিন দিন Grow করায় না, রূপান্তর করায় না, আপনার জ্ঞান প্রসারিত করে না, আপনাকে অমর করে না। কিন্তু আপনার কাজ/ কৃতিত্ব আপনাকে ঐ দরজাগুলো খুলে দেয়, প্রতি নিয়ত আপনি আপনার মাঝে নতুন করে জন্ম নিতে থাকেন।
আপনি কয়টা বাড়ি করেছেন সেটা কেউ অনুসরন করে না, মানুষ অনুসরণ করে আপনার সাফল্য গুলো কিভাবে লাভ করলেন। শুধুমাত্র বিশাল অট্টালিকা করার পিছনে নিজের ধ্যান-জ্ঞ্যান দিয়ে অধ্যাবসা করা, সেটি কোন ধরনের সাফল্যতা নয় অন্তত আমার কাছে। শুনেছি , দেশের কিছু ভিক্ষুকদের ভিক্ষা করেই নাকি পাঁচতলা বাড়ি আছে।
জীবনে সাফল্যতা অর্জন করা যেনো একটা আলোর দ্বীপ, যেই আলো মানুষের আশায় জ্বলে থাকে।

Comment here