উখিয়াএক্সক্লুসিভটেকনাফরোহিঙ্গা সমাচার

নিখোঁজের ১০ দিন পর টেকনাফে টমটম চালকের মৃতদেহ উদ্ধার : ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড় কেন্দ্রিক সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয় : টেকনাফে থামছেই না অপহরণ বানিজ্য :

নিখোঁজের ১০ দিন পর টেকনাফে টমটম চালকের মৃতদেহ উদ্ধার :

ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড় কেন্দ্রিক সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয় :

টেকনাফে থামছেই না অপহরণ বানিজ্য :

আতঙ্কে সাধারণ রোহিঙ্গা ও স্হানীয় বাংলাদেশি

টেকনাফ প্রতিনিধি :

নিখোঁজের ১০ দিন পর মৃত উদ্ধার করেছে টেকনাফের মোহাম্মদ (২০) নামের এক টমটম চালককে। ২১ জানুয়ারি শনিবার দুপুর ১ টার সময় হোয়াইক্যং-বাহারছড়া ঢালাতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে । সে উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং গ্রামের বাদশা মিয়ার ছেলে। গত ১২ জানুয়ারি থেকে টমটম চালক মোহাম্মদ (২০) এর হদিস পাচ্ছিল পরিবার এমনটি নিশ্চিত করেছেন হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী। এ ধরনের ঘটনায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া সাধারণ রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাংলাদেশিরা অপহরণ আতংকে দিনাতিপাত করছে। পাহাড় কেন্দ্রিক সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলোই মূলত এই আতংকের কারণ। টেকনাফের গহিন পাহাড়ে আস্তানা গড়ে বাংলাদেশিদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে সন্ত্রাসীরা। সময়ে সময়ে সাধারণ রোহিঙ্গারাও অপহরণের শিকার হচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলো অপহৃতদের হত্যার পর লাশ গুম করার অভিযোগও আছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, আগে আশ্রয় কেন্দ্রে মাদক ইয়াবা ও স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেত ১০-১৪টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দেড় বছর আগে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পে নিস্ক্রিয় হয়ে উঠে। অনেকে সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে পাহাড়ে অবস্থান নেয়। অর্থের জোগান পেতে তারা স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে নেমেছে। তাতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী হাজারো পরিবার আতঙ্কে রয়েছেন।

সর্বশেষ। কক্সবাজারের টেকনাফে অপহৃত ৬ রোহিঙ্গা তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন। ১৪ জানুয়ারি শনিবার সন্ধ্যায় অপহরণকারীরা চাকমারকুল পাহাড়ি এলাকায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ২১ ও ২২ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ (সিআইসি) মো: মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি সংশ্লিষ্ট এপিবিএন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলেন,” অপহৃত ৬ জন রোহিঙ্গা ফেরত এসেছে।”
অপহরণের এ ঘটনায় একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মঞ্জুরুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় চাকমারকুলের স্থানীয় বাসিন্দা মো. বিল্লাল নামে এক অপহরণকারীকে আটক করা হয়।
এর আগে শুক্রবার রাতে টেকনাফের চাকমারকুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে কাজের সন্ধানে বের হলে একদল ‘পাহাড়ি সন্ত্রাসী’ তাদের ধরে নিয়ে যায়। এরপর পরিবারের কাছে জনপ্রতি ৫০ হাজার করে মোট ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

এ বিষয়ে এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ছয় জন রোহিঙ্গাকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে আমরা কয়েকটি জায়গায় তাদের উদ্ধারে অভিযান চালাই। শনিবার সন্ধ্যায় তাদের ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা।
ফেরত আাসা অপহৃতদের স্বীকারোক্তি মতে এ ঘটনায় স্থানীয় ওই অপহরণকারীকে আটক করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত বাকিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসা রোহিঙ্গারা হলেন, টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চাকমারকুল ২১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা জাহিদ হোসেন (৩৩), মো. ইদ্রিস (২০), মো. ফরোয়াজ (৩৯), মো. জোহার (৩১), মোহাম্মদ নূর (৩৪) ও নুরুল হক (৩১)।
এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: আবদুল হালিম জানান, ” অপহরণের এ ঘটনায় মোট দু”জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দিও প্রদান করেছে।
তা ছাড়া বাহারছড়ায় আট জনকে অপহরণের ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান ওসি মো আবদুল হালিম।

গত ৮ জানুয়ারি রবিবার ভোররাতে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের বড় লেচুয়াপ্রাং এলাকা থেকে চার কৃষককে অপহরণ করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তাঁরা হলেন লেচুয়াপ্রাং গ্রামের আবদুস সালাম, আবদুর রহমান এবং দুই ভাই মুহিব উল্লাহ ও আবদুল হাকিম। পরে অপহৃত এই চার কৃষকের মধ্য তিনজনকে ছয় লাখ টাকার মুক্তিপণের বিনিময়ে ফিরে এসেছেন। গত ১০ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে হ্নীলা পাহাড়ি এলাকা থেকে তাঁরা ছাড়া পান। এর একদিন পর বুধবার আব্দুস সালাম মেটা অংকের মুক্তিপণ দিয়ে সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়।
আবদুস সালামের ছোট ভাই রফিক আহমদ জানান, রাতের বেলায় বন্য হাতির দল ভুট্টাখেতে নেমে পড়ে। পাহারার জন্য অপহৃত চারজন টংঘরে ঘুমিয়েছিলেন। ভোররাত সাড়ে চারটার দিকে অস্ত্রধারী ১৫-২০ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ওই চারজনকে অপহরণ করে পাহাড়ের ভেতরে নিয়ে যায়। পরে তারা ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরেন।
এ ছাড়া গত ১৮ ডিসেম্বর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকার খালে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন আট ব্যক্তি। তারা ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন।

হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, গত ১৮ ডিসেম্বর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৮ কৃষককে অপহরণ করেছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ৪ দিন পর ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন সবাই।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, ৫ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প

গুলোতে ১২৩ জন খুনের শিকার হয়েছেন। মুক্তিপণের জন্য ৫ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকেই অপহরণ করা হয়েছে ২০৭ জন রোহিঙ্গাকে।

পুলিশ জানায়, গত ২ আগস্ট টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের একটি পাহাড়ি জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে অপহরণের শিকার চার বাংলাদেশি নাগরিককে উদ্ধার করেছে র‍্যাব।

৩০ জুলাই রাতে তাঁদের মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করেছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। উদ্ধার ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালীয়া পাড়ার আমিনুর রহমান (১৪), মোহাম্মদ নুর (১৩), মো. ইলিয়াস (৩৮) ও সৈয়দ আহাম্মদ (৬৫)।

র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে পাহাড়ের ডেরাতে নিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা অন্তত ৪৩ জনকে হত্যা ও লাশ গুম করেছে বলে অভিযোগ আছে। নিহতদের মধ্যে ৩২ জন রোহিঙ্গা ও ১১ জন বাংলাদেশি। ক্যাম্প কেন্দ্রিক একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর কয়েকশত সদস্য এখনো রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড় ও আশপাশের জঙ্গলে পরিখা ও গোপন আস্তানা তৈরি করে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে।
রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একাধিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেন মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) চালান সরবরাহকারী রোহিঙ্গা নবী হোসেন, মুন্না, আবদুল খালেক । এ ছাড়া বিশাল একটা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা)।
মাদক চোরাচালান, ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে গত চার মাসে দুই পক্ষের সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ২৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই রোহিঙ্গা মাঝি, যারা কিনা আরসা বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ।
৮ এপিবিএন গত এক বছরে টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়-জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আমেরিকার তৈরি একটি এম-১৬ রাইফেলসহ ২৩৫টি অস্ত্র, ৫৩৪টি গুলি, ৯১ ভরি সোনাসহ ১ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছিল। ড্রোন উড়িয়ে পাহাড়ে খনন করা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পরিখার সন্ধান পেয়ে সেখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।
১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, মাদক চোরাচালান, আধিপত্য ও অপহরণ বানিজ্যকে ঘিরে কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে। চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনছিপ্রাং, রইক্ষ্যং, পুটিবনিয়া, কম্বন, কান্ঞর পাড়ার পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী শত শত পরিবার রোহিঙ্গা ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি রয়েছে। এ পর্যন্ত চারজন স্থানীয় বাসিন্দাকে অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের একজন হোয়াইক্যং আলী আছিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরি
আবদুর রশিদ (৪০) বলেও জানান তিনি।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া, জাদিমোড়া , লেদা, আলীখালী, রঙ্গিখালী, পানখালী, মরিচ্চ্যঘোনা এলাকার পরিবার গুলো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ভয়ে আতংক গ্রস্হ । রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা গত এক বছরে ৫০ জনের বেশি মানুষকে ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করেছে। চাঁদা না পাওয়ায় ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক ও স্থানীয় বাসিন্দা মো. হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পুলিশ, এপিবিএনসহ বিভিন্ন দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, গত ৫ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে ১২৩ জন খুনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৯১ জনকে হত্যার ঘটনায় করা ৮১ মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৮৪ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে। অবশিষ্ট ৩২ জন খুন হয়েছেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একাধিক বাহিনীর গোলাগুলিতে এবং অপহরণের পর খুন-গুমের ঘটনায়। মুক্তিপণের জন্য গত ৫ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকেই অপহরণ করা হয়েছে ২০৭ রোহিঙ্গাকে।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর তিন মাসে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন প্রকারের অপরাধের ৫ হাজার ২২৯ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪২৫টি। সবচেয়ে বেশি মাদক মামলা ১ হাজার ৫৬৪টিতে আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ৩৮৫ জন রোহিঙ্গাকে। একই সময়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছিল ১৭৬টি অস্ত্র।

Comment here