রোহিঙ্গা সমাচার

মিয়ানমারে নিহত সেই শিশুর বাবার সাক্ষাৎকার

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, টেকনাফ ভিশন ডটকম :

সেই ছবিটির কথা মনে আছে? হলুদ রঙের পোশাক পরিহিত নিষ্পাপ এক শিশু। মুখ থুবড়ে কাদামাটিতে পড়ে থাকা। কিছুদিন আগে নাফ নদীর তীরে মিলেছিল তার নিথর দেহ। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির গুলি থেকে রক্ষা পায়নি নিষ্পাপ ওই শিশু। সেদিন বিজিপির হাতে নিহত হন শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নারী-পুরুষ।

নিহত সেই শিশুর নাম সোহাইত। ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শিশু সোহাইতের বাবা জাফর আলম।

মিয়ানমারের মংডু বড় গওজি বিলের হতভাগা জাফর আলম পরিবারের সকলকে হারিয়ে এখন নিঃস্ব-রিক্ত। নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নাফনদীতে মারা যায় তার পরিবারের সকল সদস্য।

গত ৩০ ডিসেম্বর লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেখা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয় আইলান কুর্দিখ্যাত নিহত রোহিঙ্গা শিশু সোহাইতের বাবা জাফর আলমের সাথে।

মিয়ানমারের অবস্থা বর্ণনা করে তিনি, ‘উপরে হেলিকপ্টার আর নিচে মিলিটারি গুলি চালিয়েছে, দেশে থাকতে না পেরে চলে এসেছি। বাংলাদেশে নিয়ে আসার সময় বিজিপি গুলি ছুড়ে নৌকা ডুবিয়ে দেয়। সেখানে আমার পরিবারের সকল সদস্যই মারা যায়।’

এক প্রশ্নের উত্তরে জাফর আলম বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশেও বেশ ভালো নেই। কষ্টে আছি।’

তিনি বলেন, ‘অং সান সু চি আমাদের জন্য কিছু করছে এমন নজিরও নেই। মিলিটারি জেনারেল আর সু চি অত্যাচারের কথা অস্বীকার করেই চলছে। এতো অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করা যায় না। কোনো দেশ নাগরিকত্ব দিলে সেখানে চলে যাব।’

সোহাইতের বাবা জাফর আলম বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গারা কষ্টে আছি। বার্মায় শুধু মুসলমানদেন নিপীড়ন করা হচ্ছে। অন্য গোষ্ঠীকে নিপীড়ন করছে না। অং সান সু চি’র সরকার ও বৌদ্ধরা বা ৯৬৯ গ্রুপ আরাকানে যাতে মুসলিমরা থাকতে না পারে তাই চাচ্ছে। বড় গওজি বিল, ছোট গওজি বিল, খোলা বিল, জামবনিয়া গ্রাম সম্পূর্ণ শেষ করে দিয়েছে। অনেক মানুষ মেরে ফেলেছে। পুড়িয়ে মেরেছে। তাই বিশ্ববাসীকে আবেদন জানাচ্ছি, আপনারা বিচার করুন। আমরা বিচার চাই।’

জাফরের সাথে কথা বলার আগেই তিনি দ্রুত গিয়ে নিয়ে আসলেন দু ছেলের লেমিনেটেড ছবি।

তিনি বলেন, ‘উপরে হেলিকপ্টার ও নিচে মিলিটারি গুলি চালিয়েছে, দেশে থাকতে নাপেরে চলে এসেছি। আমি গ্রাম ছেড়ে রাইম্যাবিলে ছিলাম, পরে সাতরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসি। প্রাণ বাঁচাতে পারছিলাম না ওখানে, আমার পরিবার রাইম্যাবিল ছিল, সেখান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার সময় বিজিপি গুলি ছুড়ে নৌকা ডুবিয়ে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের দু ছেলে, মো. সোহাইত ও সোফাইত, স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম ছাড়াও শাশুরি নূর বেগম, ফুফাতু বোনের মেয়ে রোকিয়া, এ ছাড়া আমার চার ভাগিনা, জ্যাঠাতো বোন মারা যায়। একই রাতে নৌকা ডুবিয়ে দেয় দুটি, সেখানে ৩৪ জন আরোহী ছিল। ৪ জন বেঁচে ছিল। আর ৩০ জন নিখোজেঁর মধ্যে ৭ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় বুড়া সিকদার পাড়া এলাকায়।’

‘আমার আর কেউ নেই, বাচ্চা দুটিও শেষ, বিবিও শেষ। ছোট ছেলের বয়স ছিল এক বছর ৫ মাস। বড়টার বয়স সাড়ে ৩ বছর। কেউ বেঁচে নেই।’

ছোট ছেলে সোহাইতের স্মৃতিচারণ করে বাবা বলেন, ‘আমার সাথেই ছেলে বেশি খেলাধুলা করত, আমি করতাম দোকান, দোকান থেকে ঘরে আসামাত্র মায়ের কোল ছেড়ে ছেলে আধোস্বরে আব্বা আব্বা ডাকতে চলে আসত। মায়ের কোল থেকে নেমে আসত। ছেলে হামাগুড়ি দিতে পারত।’

‘আমার দুনিয়াতে বেঁচে থেকে লাভ নেই, মরে যেতে ইচ্ছা করে। আমি কী নিয়ে বেচেঁ থাকব। অশান্তিতেই আছি। বার্মা সরকারের কারণে আমার জীবনে বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটল—’ জাফর আলম।

Comment here