আন্তর্জাতিকএক্সক্লুসিভদৃষ্টিপাত

কারাভোগ শেষে স্বদেশে ফেরার প্রহর গুনছে আরো দেড় শতাধিক বাংলাদেশী : মিয়ানমারের বুথিডং কারাগারে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন

কারাভোগ শেষে স্বদেশে ফেরার প্রহর গুনছে আরো দেড় শতাধিক বাংলাদেশী :
মিয়ানমারের বুথিডং কারাগারে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, টেকনাফ ভিশন :

মিয়ানমারের বুথিডং কারাগারে আটকে আছে অন্তত আরো দেড় শতাধিক বাংলাদেশী। বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে দূ:সহ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা । এদের মধ্যে গত ৩ অক্টোবর সেই কারাগার থেকে ফিরে এসেছেন ২৯ জন বাংলাদেশী নাগরিক। ফেরত আসা বাংলাদেশীদের মধ্যে ২৩ জন কক্সবাজার জেলার, চারজন বান্দরবান জেলার এবং দুজন রাঙ্গামাটি জেলার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং এর সিটওয়ে কনস্যুলেটের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে দীর্ঘ ১৮ মাস পর সর্বশেষ প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়েছে। এ আগে গত ২০২২ সালের ২৩ মার্চ মিয়ানমার থেকে ৪১ জন বাংলাদেশী নাগরিককে প্রত্যাবাসন করা হয়েছিল। মিয়ানমারের বিভিন্ন কারাগারে সাজাভোগদের মধ্যে কেউ বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ শিকার করে নাফনদী হয়ে ঘরে ফেরার সময় মিয়ানমার সীমান্ত পুলিশ ধরে নিয়ে সাজা দিয়েছে এমন যেমন রয়েছে।আবার সাগর পথে মালয়েশিয়াগামী, মিয়ানমারে মাদক পাচারকারীদের পণ হিসেবে গিয়ে পরবর্তী সময়ে সেখানে সরকারি বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাদণ্ড ভোগ করছে এমনও রয়েছে।
সম্প্রতি বুথিডং কারাগার থেকে পাঠানো চিঠি ও ফিরে আসা বাংলাদেশী নাগরিকদের সাথে
কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার বুথিডং কারাগারে বন্দি আছে আরো অন্তত ১৫০ জন বাংলাদেশী। এদের মধ্যে সাগর থেকে ধরে নিয়ে গেছে এমন আছে অনেক। তাদেরকে বর্ডার ক্রস বলে ৫ বছর কারাদণ্ডও দিয়েছে। কিন্তু আইনগত ভাবে আছে বর্ডার ক্রস করলে ৬ মাস কারাভোগ করার আইন মিয়ানমারে। মিয়ানমার বুথিডং কারাগারে ৯২ জনের সাঁজাভোগ শেষ হয় অন্তত ৬ মাস আগে। এর আগেও অন্তত ৪৪ জন বাংলাদেশী নাগরিক বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ শেষে আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ফেরার অপেক্ষায় ছিল। যাদের মধ্য থেকে ২৯ জনকে গত ৩ অক্টোবর মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি”র সাথে পতাক বৈঠকের মাধ্যমে হস্তান্তর করেছেন। এখনো সাজা ভোগ শেষে স্বদেশে ফেরার প্রহর গুনছেন
সাবারং ইউনিয়ন শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়ার ৯ নং ওয়ার্ডের ১৪ জন। তারা হচ্ছে নুরুল কবিরের ছেলে মোহাম্মদ হেলাল, হোসেন আলীর ছেলে জাফর আলম,আব্দু শুক্কুরের ছেলে মোহাম্মদ ইসহাক, লেড়ু মিয়ার ছেলে মো: জসিম উদ্দীন, মোহাম্মদ মমতাজের ছেলে মোহাম্মদ ইসমাইল, পেঠান আলীর ছেলে শবি রহমান, মোহাম্মদ কাশেমের ছেলে নূর কালাম,ফরিদ আলমের ছেলে আলী আকবর, আব্দু শুক্কুরের ছেলে মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, আলী হোসেনের ছেলে সোলতান আহমদ ও রশিদ আহমদ (ক্যাম্প পাড়া), কাদির হোসেনের ছেলে মহি উদ্দীন, মৃত মোহাম্মদ আলমের ছেলে মোহাম্মদ রফিক (কচুবনিয়া) ও মমতাজ মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ হোছাইন ( মধ্যম কুতুবদিয়া)।
এ ছাড়া বিভিন্ন প্রলোভনে পড়ে সাগর পথে অবৈধ ভাবে মালয়শিয়া যাওয়ার সময় চলতি বছর ২০২৩ সালের ৭ মে ও অন্যামান্য সময়ে মিয়নমারের ইয়াংগুন উপকূলে আটক হয় অন্তত ২২ জন বাংলাদেশী। যাদের সকালের বাড়ী টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়ন ও হ্নীলা ইউনিয়নে। পরবর্তীতে মিয়নমার সরকার বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত করে ইরাবতি কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে তাদের সাজা মৌওকুপ করে মিয়নমার সরকার বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য গত ১৬ আগষ্ট রাখাইন রাজ্যের বুথিডং কারাগারে নিয়ে আসে। এরা হচ্ছেন, সাবরাং ইউনিয়নের খারিয়াখালী গ্রামের মৃত আব্দু শুক্কুরের ছেলে মোহাম্মদ হোসন, কবির আহমেদের ছেলে হোসন আহমেদ, সৈয়দ আহমেদের ছেলে আব্দুল আমিন, মীর আহমেদের ছেলে ইসমাইল, আব্দুল মজিদের ছেলে আকতার ফারুক, কবির আহমেদের ছেলে সাদ্দাম হোসেন, সাবরাং কুরাবুইজ্জা পাড়ার আব্দু রশিদের ছেলে রেজাউল হক, রশিদ আহমেদের ছেলে জিয়াউর রহমান, লাল মোহাম্মদের ছেলে নুরুল আলম, মোজাহের মিয়ার ছেলে সৈয়দ আলম, ইমাম হোসেনের ছেলে নূর কায়েস, কালা মিয়ার ছেলে কাদির হোসাইন, আব্দুল্লাহর ছেলে কেফায়েত উল্লাহ, আব্দুল গফুরের ছেলে জাফর উল্লাহ, মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, আব্দুল গফুরের ছেলে মোহাম্মদ উল্লাহ, বেলাল উদ্দিনের ছেলে নিজাম উদ্দিন, সাবরাং শাহপরীর দ্বীপ ডাংগর পাড়ার হোসন আহমেদের ছেলে কেফায়েত উল্লাহ, সাবরাং বাহারছড়া গ্রামের কাশিম আলীর ছেলে ফরিদ আলম, মুন্ডার ডেইল গ্রামের আমির হোসাইনের ছেলে সৈয়দুল আলম,পুরান পাড়ার জেবর মুল্লুকের ছেলে মাহমুদুর রহমান ও হ্নীলা ইউনিয়নের জাদি মোড়া এলাকার মোহাম্মদ হোসনের ছেলে ইমাম হোসেন। সব মিলে অন্তত দেড় শতাধিক বাংলাদেশী স্বদেশ ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ ব্যটালিয়ন (২-বিজিবি) অধিনায়ক লেপ্টেন্যান্ট কর্ণেল মো: মহিউদ্দীন আহমেদ।
তিনি জানান, ” মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি”র সাথে আমাদের (বিজিবি) সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রয়েছে। কারাভোগ শেষ হওয়া বাংলাদেশীদের ফেরত আনার প্রক্রিয়াটি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সম্পন্ন করতে হয়।তাই সেই প্রক্রিয়া যাতে দ্রুত করা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করছে বিজিবি।”
মিয়ানমারের আটক বাংলাদেশী জেলেদের স্বজন টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়ার নুরুল কবির, আবদুল গফুর ও মোহাম্মদ আয়াজ জানান, ” মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) গত ২০২২ সালের ১৫ মার্চ জীবিকার তাগিদে সাগরে মাছ ধরতে গেলে সেন্টমার্টিন দ্বীপের কাছাকাছি সাগরের পূর্ব দক্ষিণ দিকে বাংলাদেশের জল সিমানায় মাছ ধরারত অবস্থায় ৪ টি ফিশং বোট ও জাল সহ ১৮ জন বাংলাদেশী মাঝিমাল্লাকে মিয়ানমারের নৌবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন পত্র : মিয়ানমার কারাগার থেকে ফিরিয়ে আনার আবেদন পত্র ইউএনও কে হস্তান্তর করছেন স্বজনরা।উক্ত ১৮ জন মাঝিমাল্লার মধ্যে ৪ জন অপ্রপ্ত বয়স্ক থাকার কারণে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট ১৪ জনকে বিভিন্ন মিয়াদে সাজা দিয়ে মিয়ারমারের বুথিডং কারাগারে আটক রাখা হয়। উক্ত আটককৃত মাঝিমাল্লার উপারজিত অর্থ দিয়ে ঘর সংসার চলে। তাদের একমাত্র আয়ের উৎস সাগরে মাছ ধরে সংসার চালানো। এসব পরিবার গুলো খুব অসহায় ও দিনে এনে দিনে খাওয়া প্রকৃতের লোক। সকলের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি মিয়ানমারের বুটিডং নামক কারাগারে আটক থাকার কারণে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। বছর দেড়েক ধরে সন্তান হারা মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয় স্বজন ও ছেলে মেয়েরা, এবং পরিবারের অন্যান্য ব্যাক্তি বর্গ তাহাদের অনুপস্থিতে উৎকন্ঠায় , এমতা অবস্থায় তাহাদের অনুপস্থিতে জীবন নির্বাহ করা খুবই কঠিন ও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাদেরকে দ্রুত ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত আবেদনও করেছেন তারা।
টেকনাফের সাবরাং কুরাবুইজ্জা পাড়ার বাসিন্দা মিয়ানমারের কারাগারে আটকদের স্বজন সামিরা আক্তার, খালেদা বেগম, মাহমুদা খাতুন,আব্দুল গণী জানান, মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে অবৈধ ভাবে
সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে মিয়ানমারের ইয়াংগুন উপকূলে ধরা পড়ে একি এলাকার অন্তত ২১ জন বাংলাদেশী নাগরিক। সেখানে একটি কারাগারে সাজা ভোগ শেষে তাদের বুথিডং কারাগারে নিয়ে আসে গত ১৬ আগস্ট। তারা এখন বাংলাদেশে ফিরে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের নিকট আকুল আবেদন জানাচ্ছি। যেন দ্রুত সময়ে আমাদের স্বজনদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্হা করেন। তারা গত ৫ অক্টোবর বিকেলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত দরখাস্ত করেছন বলেও জানান তারা।
এ প্রসংগে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: আদনান চৌধুরী বলেন, ” মিয়ানমারের আটক আরো বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনার জন্য স্হানীয় স্বজদের একটি আবেদন হাতে পেয়েছি। এটি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার ব্যবস্হা নেওয়া হয়েছে। ” তিনি আরো জানান, বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২৯ জন বাংলাদেশীকে ফেরত আনা হয়েছে। মিয়ানমারের আটক বাংলাদেশী জেলেদের বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা নেওয়া হয়েছে। ”
এ প্রসংগে সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানান,” নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশী জেলেদের ধরে নিয়ে সাজা দেওয়ার ঘটনা অমানবিক। এ ধরনের ঘটনা প্রতিবেশী দু” দেশের মধ্যে সম্পর্ক বিনষ্ট করে। এসব বিষয়ে সীমান্ত সম্মেলন গুলোতে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। ”
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী জানান,” আমার এলাকার বেশ কজন বাংলাদেশী জেলে মিয়ানমার কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। তাদেরকে দ্রুত ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।”

Comment here