এক্সক্লুসিভজাতীয়

কেমন আছে সাত বীরশ্রেষ্ঠের স্বজন, স্মৃতিচিহ্ন

 ডেস্ক

কেমন আছে সাত বীরশ্রেষ্ঠের স্বজন, স্মৃতিচিহ্ন

মহান বিজয় দিবস আজ। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে এসে কেমন আছে দেশমাতার জন্য জীবন উত্সর্গ করা সাত বীরশ্রেষ্ঠের পরিবার? তাঁদের জন্মভিটা, স্মৃতিচিহ্ন, স্মৃতিজাদুঘর কতটুকু যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হচ্ছে? স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা কিভাবে জীবন যাপন করছেন? পরিবারের সদস্যরা বলছেন, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে খোঁজখবর নেওয়া হলেও বাকি সময় তাঁদের ভালোমন্দের খবর কেউ রাখে না।

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের মা মালেকা বেগম (৯৫)। তিনি শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভুগছেন। সরকারি যে ভাতা পান তা দিয়ে ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারেন না এই বীরমাতা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার নিজের জন্য কিছুই চাওয়ার নেই।

সরকার শুধু আমাদের পরিবারের খোঁজ রাখলেই চলব। ’

বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ পাঠাগার ও স্মৃতি জাদুঘর ফরিদপুরে মধুমতী নদীর ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে নদীগর্ভে বিলীন হবে এই বীরশ্রেষ্ঠের মূল্যবান স্মৃতিচিহ্ন।

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের পৈতৃক ভিটা পড়ে আছে চরম অবহেলায়। একই সঙ্গে বীরশ্রেষ্ঠের নামে গ্রামের নামকরণের সরকারি সিদ্ধান্ত হলেও আটকে আছে কাগজে-কলমে।

নরসিংদীর রায়পুরায় প্রতিষ্ঠার ৯ বছরেও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি এই বীরশ্রেষ্ঠের নামে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। গ্রন্থাগারে কিছু বই থাকলেও জাদুঘরে বীরশ্রেষ্ঠের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের বাড়ি সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে। ঝিনাইদহের মহেশপুরে খোর্দ খালিশপুর গ্রামের বাড়িটির সংস্কার আজও হয়নি। এ ছাড়া গ্রামের নাম পরিবর্তন করে হামিদনগর করা স্থানীয় অধিবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি থাকলে তা পূরণ হয়নি।

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের জন্মভিটা সংস্কার নেই। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামের বীরশ্রেষ্ঠের জন্মভিটা অবহেলায়-অযত্নে পড়ে আছে। স্বজন ও স্থানীয়রা এটিকে পরিত্যক্ত করেছে অনেক আগেই। এখন আর ওই ঘরের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিনের পৈতৃক ভিটার জীর্ণদশা। নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার পূর্বের বাগপাচড়ায় বাড়িটি এখন ব্যবহারের অনুপযোগী।

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের নামে নড়াইলে গৃহীত নানা সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলেও এসব উদ্যোগের অনেকটাই রয়েছে অসম্পূর্ণ। বিস্তারিত আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে—

শ্বাষকষ্টে ভুগছেন বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের মা মালেকা : শ্বাসকষ্ট, গ্যাস্ট্রিক, প্রেসারসহ নানা রোগে ভুগছেন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের মা মালেকা বেগম। তাঁর প্রতি মাসে কেবল ওষুধ কিনতে লাগে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। সরকার থেকে তাঁকে দেওয়া হয় মাত্র ৯ হাজার টাকা। ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের মৌটুপী গ্রামেই বসবাস করছেন মালেকা মেগম।

গতকাল শুক্রবার সকালে ওই গ্রামের ‘শহীদ স্মরণীকা’র বাসভবনে গিয়ে কথা হয় মালেকা বেগমের সঙ্গে। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার শরীর বেশি ভালো না। আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার দেখাচ্ছি। ওষুধ খাচ্ছি। ’

বীরশ্রেষ্ঠ সন্তানের স্মৃতিচারণা করে মা মালেকা বেগম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই কামাল ছিল খুব দুষ্টু প্রকৃতির। তবে খেলাধুলায় ছিল প্রথম। তিন-চারজন মিলে যে কাজটি করতে পারত, সেই কাজটি মোস্তফা একাই করতে পারত। মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর আগে বিয়ে করে মোস্তফা কামাল। যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী পিয়ারা বেগমের গর্ভে ছিল সন্তান। যুদ্ধে যাওয়ার সময় আমাকে বলেছিল, মা আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আমাকে দোয়া করো। সবাই ফিরলেও আমি মনে হয় আর জীবিত ফিরে আসব না মা। টাকা-পয়সা যা পাও তা দিয়া খাওয়া-দাওয়া কইরো। তুমি দেখে নিও আমাগোরে কেউ হারাইতে পারবো না। ’

মালেকা বেগম বলেন, ‘বর্তমানে পরিবারে উপার্জন করার মতো কেউ নেই। সরকার থেকে বীরশ্রেষ্ঠ সম্মানী ভাতা সাত হাজার ও পেনশন বাবদ দুই হাজার টাকা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। কামালের ঘরের দুই নাতির মধ্যে সেলিম বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে চাকরি করছে। ছোট ছেলে শাহিন পড়ালেখা করছে। পড়ার খরচ, ওষুধ খরচ আর সংসারের যাবতীয় খরচ দিয়ে সংসার ঠিকমতো চলে না। প্রতিবছরের মার্চ আর ডিসেম্বর মাস এলেই প্রশাসনের লোকজন আর সাংবাদিকরা খবর নিতে আসেন। কিন্তু এরপর আর কেউ খোঁজখবর নেয় না। আমার নিজের জন্য কিছুই চাওয়ার নেই। সরকার শুধু আমাদের পরিবারের খোঁজ রাখলেই চলবো। ’

১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর গ্রামে মোস্তফা কামালের জন্ম। ১৯৮২ সালে রাক্ষুসী মেঘনা নদীতে ওই বাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর পরিবার-পরিজন নিয়ে ভোলা শহরের আলীনগর ইউনিয়নের মৌটুপী গ্রামে চলে আসে তাঁর পরিবার। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের পক্ষ থেকে ৯২ শতাংশ জমির ওপর একতলা পাকা ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়। যার নাম দেওয়া হয় শহীদ স্মরণীকা। তখন থেকে এখানেই বসবাস করছেন তাঁরা। বর্তমানে বাড়িটির জীর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। মেরামতের ব্যবস্থা নেই।

ফরিদপুরে মধুমতী নদীর ভাঙনের মুখে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাঠাগার ও স্মৃতি জাদুঘর : ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের রউফনগর গ্রামে মধুমতী নদীর ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে ওই এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি ভাঙনের হুমকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের কামারখালী বাজার থেকে রউফনগর গ্রামে যাওয়ার একমাত্র ইটের রাস্তাটি গন্ধখালী অংশে দীর্ঘদীন ধরে ভাঙছে। ভাঙতে ভাঙতে নদী এখন জনপদে ঢুকে পড়েছে।

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের লাইব্রেরিয়ান মুন্সী সাইদুর রহমান বলেন, ‘নদীভাঙন থেকে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি রক্ষা করতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই। ’

সাইদুর রহমান আরো বলেন, ‘এ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মারক নেই। দর্শনার্থীরা এসে স্মারক না দেখে মন খারাপ করে ফিরে যাচ্ছে। তাই এ জাদুঘরের জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহ করা দরকার। ’ গন্ধখালী গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা নবাব আলী মোল্লা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠের একজন হলেন আমাদের মাটির সন্তান রউফ। তাঁর নামে নির্মিত এ স্মৃতি জাদুঘরটি নদীভাঙন থেকে রক্ষার দায়িত্ব সরকারের নেওয়া উচিত। ’

ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. লোকমান হোসেন মৃধা বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠের নামের জাদুঘরটির এখনো পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ওই কমপ্লেক্সে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরালসহ বিভিন্ন কাজ আমরা শিগগিরই শুরু করব। যাতে স্বাধীনতা দিবসের আগেই জাদুঘরটির নতুন রূপ দেওয়া যায়। ’

ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. আব্দুর রহমান জানান, নদীভাঙন রোধে নদীতীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে।

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান স্মৃতিচিহ্ন নিশ্চিহ্ন : নরসিংদীর রায়পুরায় প্রতিষ্ঠার ৯ বছরেও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। গ্রন্থাগারে কিছু বই থাকলেও জাদুঘরে বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতিচিহ্ন নেই। অবহেলায় পড়ে আছে তাঁর পৈতৃক ভিটা। একই সঙ্গে বীরশ্রেষ্ঠের নামে তাঁদের গ্রামের নামকরণের সরকারি সিদ্ধান্তও আটকে আছে কাগজে-কলমে।

রায়পুরা উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম রামনগর। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাহমুদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের পাশেই বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্মৃতিফলক ‘বাংলার ঈগল’। ত্রিমুখী কালো পাথরের স্তম্ভ। এর একটিতে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের প্রতিকৃতি, আরেকটি জীবনবৃত্তান্ত। অপর স্তম্ভটিকে খোলা আকাশের প্রতীক হিসেবে ফাঁকা রাখা হয়েছে। মাঝে ত্রিভুজ আকৃতির স্তম্ভে টেরাকুটায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্য ফুটে উঠেছে। সবার ওপরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরনগর গ্রামের প্রবেশ নির্দেশক।

ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান ভূঞা বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠের নামে গ্রামের নামকরণের সরকারি সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি পোস্ট অফিসের সিলমহরে রামনগরের নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরনগর লিখতে পারছি না। ’

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক এনামুল হক বলেন, ‘দুইজনের কাজ একজন করলে যেমন হয় সেভাবেই প্রতিষ্ঠানটি চলছে। বছরের অধিকাংশ দিনই দেশের দূরদূরান্ত থেকে আগ্রহ নিয়ে লোকজন আসে কিন্তু জাদুঘরে কোনো সংগ্রহশালা না থাকায় তাঁরা হতাশ হয়ে ফিরে যান। ’

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের বাড়িতে কেউ থাকেন না। ফলে দরজায় ঝুলছে তালা। বাড়ির সামনে নতুন করে লাগানো হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান যুবসংঘের সাইনবোর্ড। চারপাশের বাড়িগুলোতে থাকেন বীরশ্রেষ্ঠের স্বজনরা।

জানতে চাইলে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত ইউনিয়ন, ডাকঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম না বদলানো হবে ততদিন পর্যন্ত বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরনগর নামটি সাইনবোর্ডসর্বস্ব হয়ে থাকবে। এটা বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলে পরিবারের পক্ষ থেকে ওনার স্মৃতিকর্ম দিয়ে সহযোগিতা করা হবে। ’

এ ব্যাপারে রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শিগগিরই বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ’

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের বাড়ি সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হতে যাচ্ছে : ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোর্দ খালিশপুর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের বাড়ি সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া খোর্দ খালিশপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে হামিদনগর করা স্থানীয় অধিবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু সরকারিভাবে এলাকাবাসীর সে দাবি আজও পূরণ হয়নি। খোর্দ খালিশপুর গ্রামে কলেজসংলগ্ন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে করা গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি এখনো জাতীয়করণ হয়নি। এখানে রয়েছেন দুইজন কর্মচারী—একজন লাইব্রেরিয়ান ও একজন কেয়ারটেকার। লাইব্রেরিটি জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছে স্থানীয় জনসাধারণ। জেলা পরিষদের দেওয়া অনুদানে সামান্য কিছু বেতন দেওয়া হচ্ছে দুই কর্মচারীর।

১৯৮১ সালে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের জন্মভিটায় একটি একতলা দালান বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়। বাড়িটির নাম দেওয়া হয় শহীদ স্মরণীকা। সংস্কারের অভাবে সেই বাড়িটিও এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পলেস্তারা খসে পড়ছে। বসবাসের অযোগ্যে হয়ে পড়েছে।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের তিন ভাই তাঁদের পরিবার নিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন। বাড়িটি সংস্কার করে বসবাসের উপযোগী করার দাবি পরিবারের সদস্যদের। ঝিনাইদহ থেকে খোর্দ খালিশপুরে যাওয়ার রাস্তাটির অবস্থা ভালো না। অনেক আবেদন-নিবেদনের পর রাস্তাটির ঝিনাইদহ অংশের সংস্কারের কাজ শুরু হলেও বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের গ্রাম থেকে চুয়াডাঙ্গার দিকে সাহেবখালী পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। সংস্কারকাজ করা খুবই জরুরি।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের বাড়ির সামনে কোনো স্মৃতিস্তম্ভও নেই। এলাকাবাসী ও তাঁর পরিবারের দীর্ঘদিনের দাবি—বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের বাড়ির সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের। বাড়ির আঙ্গিনায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের বাবা আব্বাস আলী মণ্ডলের কবরটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে ছিল। চলতি বছর বিজয়ের এই মাসে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কবরটি পাকা করে দেওয়া হয়েছে।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মেজো ভাই হামজুর রহমান বলেন, ‘আমরা চার ভাই তিন বোনের মধ্যে হামিদুর রহমান ছিলেন সবার বড়। এখন আমরা তিন ভাই দুই বোন জীবিত আছি। আমরা পাঁচ ভাই-বোন সবাই ভাতা পাচ্ছি। বাড়িটি সংস্কারের জন্য প্রশাসনের কাছে একাধিকবার আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। ’

মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের বাড়ির আঙ্গিনায় তাঁর বাবা আব্বাস আলী মণ্ডলের কবরটি অতিসম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। হামিদুর রহমান সড়কের সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে।

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের জন্মভিটা সংস্কার নেই : বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামের বীরশ্রেষ্ঠের জন্মভিটা অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। এটি স্বজন ও স্থানীয়রা পরিত্যক্ত করেছে অনেক আগেই। এখন আর ওই ঘরের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের ভাই মঞ্জুর রহমান বাচ্চু বলেন, ‘আমরা বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের বসতঘরটিকে সংস্কার করার জন্য বহুবার আবেদন করেছি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। তাই যে ঘরটিতে দেশের একজন শ্রেষ্ঠ বীর জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ’

মঞ্জুর রহমান বলেন, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করে। ওই জাদুঘরের অবস্থাও এখন করুণ। একজন কেয়ারটেকার জাদুঘরটি পরিচালনা করেন। জাদুঘরের অভ্যন্তরের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে আছে। ছয় মাস ধরে নেই কোনো পানির ব্যবস্থা।

মঞ্জুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, সন্ধ্যা নদীর ভাঙনে যেকোনো সময় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার, স্মৃতি জাদুঘর ও বসতভিটা বিলীন হয়ে যেতে পারে। তাঁর নামে করা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিও ভাঙনের মুখে। কেবল আশ্বাসই দেওয়া হচ্ছে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার। তবে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

মঞ্জুর রহমান আরো বলেন, ‘১৬ই ডিসেম্বর এলে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা কর্মসূচির আয়োজন করি। ওই কর্মসূচিতে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের লোকদের আমন্ত্রণ জানালে তাঁরা আসেন। এ ছাড়া আর কেউ খোঁজ নেয় না। ’

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘জাতীয় দিবসগুলোতে বিভিন্ন লোকের দেখা মেলে। এরপর আর কেউ আসে না। ’

বরিশাল জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসন গ্রন্থাগারটি পরিচালনার জন্য সহায়তা করে। আর সড়কের বেহাল অবস্থা দূর করতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে। সরকারিভাবে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের পরিবারকে নগরীর কাশিপুর এলাকায় একটি বাসভবন করে দেওয়া হয়েছে। আর পুরনো ঘরটি সংস্কারের বিষয়টি আমরা ভাবছি। ’

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের পৈতৃক ভিটার জীর্ণদশা : নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার পূর্বের বাগপাচড়ায় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন পৈতৃক বাড়িটি এখন বেহাল দশা ও ব্যবহারের অনুপযোগী। তার পরও ওই বাড়িতে বেঁচে থাকা এক পুত্র ও তিন কন্যাসন্তানের মধ্যে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী পুত্রসন্তান শওকত আলী তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাসন্তান নিয়ে অনেকটা মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছেন। বাড়ির সামনে বীরশ্রেষ্ঠের নিজের জায়গায় নির্মিত জাদুঘর ও পাঠাগার রয়েছে। কিন্তু যাতায়াতের সড়কটি চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে।

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের দুই ছেলে ও তিন মেয়ে থাকলেও তাঁর বড় ছেলে মোহাম্মদ আলী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৫ সালে মারা যান। ছোট ছেলে শওকত আলী জম্ম থেকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তিন মেয়ে নূরজাহন বেগম, রিজিয়া বেগম ও ফাতেমা বেগম চট্টগ্রামেই বাসাবাড়ি নিয়ে বসবাস করেন। বীরশ্রেষ্ঠের বেঁচে থাকা একমাত্র ছোট ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শওকত আলী তাঁর স্ত্রী রাবেয়া আক্তার ও তাঁদের একমাত্র কন্যা তাঁর পৈতৃক ভিটায় বসবাস করেন।

স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে নৌবাহিনী শওকত আলীর বসবাসের জন্য ৪০ বছর আগে তিন কক্ষের একটি একতলা দালান নির্মাণ করে দেয়। সেই থেকে শওকত আলী ওই ঘরে বসবাস করে আসছেন। বর্তমানে ওই দালানের ছাদ থেকে পানি নিয়মিত পড়ে, প্লাস্টার খয়ে যাচ্ছে, এককথায় এটি বসবাসের অনুপযোগী। নির্মাণের পর প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় শওকত আলীর পক্ষে এটি সংস্কার করাও সম্ভব হয়নি। শওকত আলীর একমাত্র আয় হচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠের তাঁর অংশের পাওয়া ভাতা ১০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তাঁর পরিবারকে চলতে হিমশিম খেতে হয়।

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রহুল আমিনের ছেলে শওকত আলীর স্ত্রী রাবেয়া আক্তার বলেন, দেশের বাড়িতে পরিবারের থাকার জন্য নৌবাহিনী কর্তৃক একতলা দালান ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়, যা বর্তমানে জরাজীর্ণ হয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তার পরও তিনি তাঁর স্বামী ও সংসার নিয়ে কোনো রকমে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছেন। তাঁর স্বামী সহজ সরল এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে কোনো কাজ করেন না, তাই ভাতার টাকা দিয়ে তাঁদের চলতে হয়। মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজন কিছু সহযোগিতা করে থাকেন। এভাবে তাঁদের জীবন চলছে। তিনি অবিলম্বে তাঁদের ঘর সংস্কার করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের ব্যবহূত বাইসাইকেল : বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের নামে নড়াইলে গৃহীত নানা সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলেও এসব উদ্যোগের অনেকটাই রয়েছে অসম্পূর্ণ। ২০০৮ সালে ‘মহিষখোলা’র নাম পরিবর্তন করে সরকারিভাবে গ্রেজেটের মাধ্যমে ‘নূর মোহাম্মদনগর’ করা হয়। তাঁর গ্রামে ঢোকার পথে নড়াইল-ঢাকা সড়কের পাশে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। তবে এই ক বছরে ব্যাপকভাবে কোনো কর্মকাণ্ড না থাকায় স্থায়ীভাবে নূর মোহাম্মদনগরের পরিচিতি পায়নি।

গ্রামবাসীর সহায়তায় ২০০৫ সালে গড়ে উঠেছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এমপিওভুক্ত না হওয়ায় হতাশ এই কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। প্রায় ৩০০ ছাত্রের এই কলেজের একটিমাত্র টিনশেড ভবন, সিলিং না থাকায় এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে শব্দ যায় অনায়াসে। এতে করে নিয়মিত পাঠদানে অসুবিধা হয়। কলেজে নেই বিদুত্ ব্যবস্থা। গরমকালে ক্লাস করতে না পেরে ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি চলে যায়। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন শিক্ষকরা। তাঁরা দীর্ঘ ১২ বছর বিনা বেতনে কলেজে চাকরি করে যাচ্ছেন শুধু কলেজটি এমপিওভুক্ত হবে এই আশায়। সর্বশেষ নানা তদবির করার পর ২০১৭ সালের প্রথম দিকে কলেজটি জাতীয়করণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

২০০৮ সালে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। মহান এই বীরের স্মরণে নড়াইলে পাঠাগার ও স্মৃতি সংগ্রহশালা স্থাপিত হলেও আজও তা নানা সমস্যায় জর্জরিত। সম্পূর্ণ অরক্ষিত এই কমপ্লেক্সের সামনে গরু চরছে, কাপড় ও ধান শুকানোর কাজ চলছে প্রতিবেশীদের।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের জন্মস্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এলাকাবাসী ও পরিবারের দাবির মুখে স্মৃতিস্তম্ভে নূর মোহাম্মদ শেখের ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। খোলা জায়গায় কিছু সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। চিহ্নিত হয়নি বীরের বাড়িটি।

এদিকে যুদ্ধচলাকালে শেষবারের মতো যে সাইকেলটি চালিয়ে নড়াইলের গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ, দীর্ঘ ৪৫ বছর পর ২০১৬ সালে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের সেই ব্যবহূত বাইসাইকেলটির সন্ধান পাওয়া যায় নূর মোহাম্মদের আত্মীয় নড়াইল সদরের ডৌয়াতলা গ্রামের অলিয়ার রহমানের ছেলে এমদাদুল হকের কাছে। এমদাদ সাইকেলটি দিয়ে আসেন নূর মোহাম্মদ শেখের স্ত্রী ফজিলাতুননেসার কাছে। ফজিলাতুননেসা সাইকেলটি তত্কালীন জেলা প্রশাসক হেলাল মাহমুদ শরীফের কাছে হস্তান্তর করেন। ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের জন্মদিনে সাইকেলটি নূর মোহাম্মদ স্মৃতি জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের স্ত্রী ফজিলাতুননেসা বলেন, ‘সাইকেল ব্যবহারকারী এমদাদের পরিবারটি খুবই গরিব। তার পরও তারা সাইকেলের মূল্য নিতে চায় না। তা ছাড়া এটা অমূল্য সম্পদের কারণে কোনো মূল্য হয় না। আমার মনে হয় বীরের সাইকেল বহনকারী এমদাদকে আমরা একটা চাকরি দিয়ে তাঁর পরিবারকে সচ্ছল করতে পারি। ’

Comment here