কক্সবাজাররোহিঙ্গা সমাচার

রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে ১৫ দফা প্রস্তাব

মেহেদী হাসান

রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে ১৫ দফা প্রস্তাব

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ অঞ্চল গড়ার তাগিদ বাড়ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে এ বিষয়ে একটি আহ্বান জানিয়েছিলেন। গত মঙ্গলবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে তোলা একটি প্রস্তাবে রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠাবিষয়ক শেখ হাসিনার ওই আহ্বান বিবেচনা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিকে ঢাকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংস্থা আসিয়ানের পার্লামেন্ট সদস্যদের (এমপি) মানবাধিকারবিষয়ক একটি ফোরাম রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের তাগিদ দিয়েছে। আসিয়ান এমপিরা মিয়ানমারের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপেরও আহ্বান জানান।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে গত মঙ্গলবার রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। প্রস্তাবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার বাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সিনেটর জেফ মার্কলের নেতৃত্বে কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদল গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সফর করেছিল। জেফ মার্কলেই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। তাঁর সঙ্গে প্রস্তাবক হিসেবে আরো আছেন সিনেটর ইয়াং, কেইনি, ম্যাককেইন, ফেইনস্টেইন, টিলিস, ডারবিন, ভ্যান হোলেন, মার্কি, ওয়াইডেন, রুবিও, ওয়ারেন, ব্রাউন, কুন্স ও স্মিথ।

১৫ দফার প্রস্তাবটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবের শুরুতেই রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার নিন্দা এবং মিয়ানমারকে সব ধরনের বৈরী আচরণ বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। কথিত রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরসার নিন্দা জানানো হয়েছে প্রস্তাবের তৃতীয় দফায়। চতুর্থ দফায় মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) অংশগ্রহণ ও রাখাইন রাজ্যে তাদের পূর্ণ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রস্তাবের পঞ্চম দফায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভূমিকার প্রশংসার পাশাপাশি এ ভূমিকা অব্যাহত রাখা এবং রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ইউএনএইচসিআর ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে পূর্ণ প্রবেশাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উদ্যোগকে পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে প্রস্তাবের ষষ্ঠ দফায়।

সপ্তম দফায় রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক নজরদারির আওতায় শান্তি রক্ষা মিশন মোতায়েন বা ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়তে বাংলাদেশের প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা বিবেচনা করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবের অষ্টম দফায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের অধিকারের নিশ্চয়তাসহ প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান স্থান পেয়েছে।

নবম দফায় বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক অস্থায়ী বসতি, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত শিবিরে বা অন্য কোনো গ্রামে স্থানান্তর গ্রহণযোগ্য হবে না। দশম দফায় রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য মিয়ানমার সরকারকে কোমল ও বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।

রাখাইন পরামর্শক কমিশনের সুপারিশের আলোকে রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণগুলো সমাধানসহ পূর্ণ নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে একাদশ দফায়। দ্বাদশ দফায় রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য তাদের রাষ্ট্রহীনতা, অধিকারের বঞ্চনার মতো ইস্যুগুলো সুরাহা করতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ত্রয়োদশ দফায় রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের অনন্য সহানুভূতি এবং ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও ত্রাণ দেওয়ার প্রশংসা স্থান পেয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই যাতে অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ, জোরপূর্বক ও অজ্ঞাতসারে না হয় সে বিষয়ে প্রস্তাবের চতুর্দশ দফায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবের পঞ্চদশ ও শেষ দফায় রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে মুক্তি দিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান স্থান পেয়েছে।

জেফ মার্কলে সিনেট অধিবেশনে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলো ভয়ংকর। তাদের আগামী প্রজন্মের বিষয়ে আমাদের চিন্তিত করে তোলে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরগুলোত আমি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের ওপর সংঘটিত ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা শুনেছি। আমি পুড়ে যাওয়া নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঘরে আগুন দেওয়ার পর তারা সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে।’

এদিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের মানবাধিকারবিষয়ক সংসদ সদস্যরা (এপিএইচআর)। একই সঙ্গে তাঁরা রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির তাগিদ দিয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক এপিএইচআরের একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গতকাল বুধবার বিকেলে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ওই তাগিদ দেয়।

এপিএইচআরের চেয়ারপারসন ও মালয়েশীয় পার্লামেন্টের সদস্য চার্লস সান্টিয়াগো বলেন, ‘আমি মনে করি, নৃশংসতার জন্য দায়ী জেনারেলদের ওপর অবরোধসহ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের এটিই সময়।’ এ ক্ষেত্রে তিনি মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে এমন দেশ যেমন—ভারত, চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা প্রত্যাশা করেন। তিনি বলেন, ওই দেশগুলোর অস্ত্র ও গোলাবারুদ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।

চার্লস সান্টিয়াগো রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনেরও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে সে বিষয়েও তাদের সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া উচিত।

এপিএইচআরের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গতকাল ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে তাদের সুপারিশগুলো তুলে ধরার মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের চার দিনের মিশন শেষ করে। সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্যরা রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

চার্লস সান্টিয়াগো বলেন, আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আসিয়ানের উচিত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখা। তিনি আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোর সরকারগুলোকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। এ ছাড়া তিনি জরুরি ভিত্তিতে আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠানের তাগিদ দেন।

থাইল্যান্ডের সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য রাচাদা ধাধিরেক বলেন, রোহিঙ্গা সংকট পুরো অঞ্চলে প্রভাব ফেলছে। এ বিষয়ে কথা বলা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ—এমনটি মনে করে নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই।

সিঙ্গাপুরের পার্লামেন্ট সদস্য লুইস এনজি বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে তাঁরা মিয়ানমারে নির্যাতন-নিপীড়নের হৃদয়বিদারক বর্ণনা শুনেছেন। এসব নৃশংসতার বিষয়ে আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোকে আরো সজাগ হতে হবে। ‘শরণার্থীদের’ বক্তব্য তাদের শুনতে হবে।

এদিকে জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের উপনির্বাহী পরিচালক জাস্টিন ফরসিথ গতকাল কক্সবাজারে বলেছেন, রোহিঙ্গা শিশুদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগে মিয়ানমারে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হতে হবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নুয়ার্ট গত মঙ্গলবার রাতে ওয়াশিংটনে ব্রিফিংয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গারা সবাই মিয়ানমারে ফিরতে চায় বলেই তিনি মনে করেন। তবে যখন রোহিঙ্গারা নিরাপদ বোধ করবে তখনই তাদের ফেরা উচিত।

 

Comment here