ক্রাইমরোহিঙ্গা সমাচার

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টর্চার সেল : দেশী-বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার : আরসা’র ওলামা বডি ও টর্চার সেলের প্রধান সালমান মুরব্বী’সহ আটক-২

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টর্চার সেল :
দেশী-বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার :
আরসা’র ওলামা বডি ও টর্চার সেলের প্রধান সালমান মুরব্বী’সহ আটক-২

টেকনাফ ভিশন ডেস্ক :


রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে
দেশী-বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার
করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব ) ১৫ “র সদস্যরা। এ সময় আটক করেছে
আরসা’র ওলামা বডি ও টর্চার সেলের প্রধান
মোঃ ওসমান প্রকাশ সালমান মুরব্বী (৫০) ও খাদ্য সরবরাহকারী মোঃ ইউনুস (২৪) কে।
২৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে র‌্যাব-১৫ এর একটি আভিযানিক দল কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার
কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়।
র‌্যাব -১৫ কক্সবাজার অফিসের
সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল’ এন্ড মিডিয়া)
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আবু সালাম চৌধুরী সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও এর সংলগ্ন গহীন পার্বত্য এলাকাসমূহে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা)’সহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এ সকল খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। যার কারণে শরণার্থী ক্যাম্প ও স্থানীয় এলাকাবাসী সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এই বছরে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আরসা’র শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামরিক কমান্ডার, গান কমান্ডার, অর্থ সম্পাদক, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র একান্ত সহকারী এবং অর্থ সমন্বয়ক, মোস্ট ওয়ান্টেড কিলার গ্রুপের প্রধান ও ক্যাম্প কমান্ডারসহ সর্বমোট ৭৩ জন আরসার সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে র‌্যাব-১৫ এর একটি আভিযানিক দল উখিয়া থানাধীন কুতুপালং ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আরসা’র শীর্ষ কমান্ডার, আরসা’র ওলামা বডি ও টর্চার সেলের প্রধান মৃত নুরুজ্জামানের ছেলে
মোঃ ওসমান প্রকাশ সালমান মুরব্বী (৫০) কে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তার তথ্যের ভিত্তিতে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডস্থ মধুরছড়া জামে মসজিদ সংলগ্ন পাহাড়ে আরসার তৈরী একটি গোপন টর্চার সেলের সন্ধান পায় এবং সেখান থেকে টর্চার সেলের সদস্য সৈয়দ হোসেন”র ছেলে মোঃ ইউনুস (২৪)কে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় উদ্ধার করা হয় ১টি নাইন এমএম বিদেশী পিস্তল ও ৪ রাউন্ড গুলি, ৪টি একনলা ওয়ান শুটার গান, ২টি এলজি, ৫ রাউন্ড ১২ বোর কার্তুজ এবং বিপুল পরিমাণ টর্চার সেলের সরঞ্জামাদি। যার মধ্যে ১টি কুড়াল, ৩টি বিভিন্ন সাইজের প্লাস, ১টি কাঠের লাঠি, ১টি স্টিলের লাঠি, ১টি করাত, ১টি নাম চাকু, ১টি লোহার রড, ১টি লোহার দা, ১টি হ্যাংগিং হুক, ১টি সিসর, ৪টি তালা, ৩টি বড় লোহার পেরেক, ২টি লোহার শিকল, ১টি রশি, ১টি কুপি বাতি এবং সুইসহ সুতার ১টি বান্ডেল।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আবু সালাম চৌধুরী আরো জানান,” গ্রেফতারকৃতরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক। গ্রেফতারকৃত সালমান মুরব্বী ২০১৭ সালে সপরিবারে অবৈধপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাইংখালীর ক্যাম্প-১৩ এর ব্লক-ডি/৪ এ বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সে আরসার ওলামা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ও কমান্ডার মৌলভী মোস্তাক আহম্মদ এবং মৌলভী আবু রায়হান এর সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এ যোগদান করে। সংগঠনে যোগদানের পর আরসার শীর্ষ নেতাদের নিকট অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পর্যায়ক্রমে সে ১৩ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক জিম্মাদার, হেড জিম্মাদার এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরসার ওলামা বডির প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব লাভ করে। তার নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার দাওয়াত গ্রুপের অন্যতম সদস্য মৌলভী লাল মোহাম্মদ এর নেতৃত্বে ১০/১২ জনের একটি গ্রুপ তৈরী করে। যারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী তরুণ ও যুবকসহ সাধারণ রোহিঙ্গাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে অথবা জোরপূর্বক আরসায় যোগদান করতো। তার এই কার্যক্রমের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা আরসায় যোগদান করেছে বলে জানা যায়। এজন্য সে প্রতি মাসে আরসা হতে মোটা অংকের টাকা পেতো এবং তার মাধ্যমেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওলামা বডির অন্যান্য সদস্যদের জন্য নির্ধারিত টাকা আসতো বলে জানা যায়। সে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ ও আরসার সেকেন্ড ইন কমান্ড ওস্তাদ খালেদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতো। সে আরসার শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে যুক্ত ছিল। উক্ত গ্রুপসমূহের মাধ্যমে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাকে ক্যাম্পে আরসার কার্যক্রম সংক্রান্ত বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করতো। ক্যাম্প ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কোন ধরণের হামলা বা নাশকতার জন্য সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার সদস্যরা সালমান মুরব্বীর পরামর্শে হামলা ও অরাজকতা সৃষ্টি, হত্যাকান্ড, অপহরণসহ নানাবিধ সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘঠিত করতো। এ সকল অপরাধের বিষয়ে সালমান মুরব্বী আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র নিকট থেকে অনুমতি গ্রহণ করতো। গ্রেফতারকৃত সালমান মুরব্বীর নেতৃত্বে ওলামা বডির অন্যান্য সদস্যরা আরসার নতুন সদস্য যোগদানে উদ্বুদ্ধ করণের পাশাপাশি আরসা হতে বের হয়ে বিভিন্ন নেতৃত্বদানকারীদের হত্যার পরিকল্পনা, হামলা, ভয় ভীতি প্রদর্শন করতো। এছাড়া শরণার্থী ক্যাম্প ও পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহে অরাজকতা ও আতঙ্ক সৃষ্টিসহ খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করতো। আরসা ওলামা বডির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ সকল অপরাধের ফলে ক্যাম্পে বসবাসরতর রোহিঙ্গারা সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তারা তাকে অপহরণ ও হত্যাসহ ক্ষেত্র বিশেষ লাশ গুম করতো।”

আরো জানা যায় যে, আরসা প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার আধিপত্য এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিরবিচ্ছিন্নভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে আরসা ২০১৯ সালের শেষের দিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে ও ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড় ও গহীন জঙ্গলে টর্চার সেল/কাচারী স্থাপন করে। আরসার কমান্ডার আবু আনাছ সর্বপ্রথম টর্চার সেলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তীতে মৌলভী আকিজ ওলামা বডির প্রধানের দায়িত্ব নেয় এবং চলতি বছরের শুরুতে সে মিয়ানমারে চলে গেলে গ্রেফতারকৃত সালমান মুরব্বী ওলামা বডির প্রধান ও উক্ত টর্চার সেলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই কাচারী বা টর্চার সেলের দায়িত্বে থাকা প্রধান ও অন্যান্য সদস্যরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের বিচারের নামে শাস্তিসহ নানাবিধ নির্যাতন করে থাকে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ধরণের কঠোর শাস্তি, অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হতো এই টর্চার সেলে। এছাড়াও আরসার ভিন্ন মতাদর্শীদেরও এই টর্চার সেলে নিয়ে এসে নির্যাতন করা হতো। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প’কে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করে গ্রেফতারকৃত সালমান মুরব্বীর নেতৃত্বে মাষ্টার কামাল, মাষ্টার ইউনুছ, জাফর আলম, মৌলভী যুবায়ের, মাষ্টার আবুল হাশিম, মাষ্টার সলিম প্রমুখ আরসার কমান্ডাররা এই ভয়ঙ্কর কাচারী বা টর্চার সেলের বিভিন্নভাবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে বলে জানা যায়। এছাড়াও শরণার্থী শিবিরের বিভিন্ন লোকজন ও স্থানীয় বাঙ্গালীদের অপহরণ করে টর্চার সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে বড় অংকের মুক্তিপণ আদায় করতো, কখনও কখনও চাহিদা মতে মুক্তিপণের টাকা আদায় করতে অপহৃত ব্যক্তির উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালাতো এই সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা।
গ্রেফতারকৃত সালমান মুরব্বী শরণার্থী ক্যাম্প-১৯ এর হেড মাঝি আনোয়ার ও সাবমাঝি ইউনূস হত্যাকান্ড, জসিম হত্যাকান্ডসহ ক্যাম্প-১৩ এর সকল হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ৬ জন হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকান্ড এবং বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টহল দলের উপর সশস্ত্র হামলার সাথে সে জড়িত রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। উক্ত সন্ত্রাসী হামলায় একজন র‌্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন। উক্ত হত্যাকান্ডের সাথে সে সরাসরি জড়িত ছিল এবং উক্ত মামলার পলাতক এজাহার নামীয় আসামি। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ ও অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ৬টির অধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
এদিকে গ্রেফতারকৃত ইউনুছ ২০১৭ সালে সপরিবারে অবৈধপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৫ এলাকায় বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সে আরসার বাংলাদেশের প্রধান কমান্ডার মৌলভী আকিজ, সামরিক শাখার কমান্ডার মাষ্টার ইউনুছ ও ছমি উদ্দীন এবং গ্রেফতারকৃত ওলামা বডির প্রধান জিম্মাদার সালমান মুরব্বীর মাধ্যমে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এ সদস্য হিসেবে যোগদান করে। সে সংগঠনে যোগদানের পর আরসার শীর্ষ নেতাদের নিকট হতে অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে আরসার সিনিয়র কমান্ডারদের খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব পালন করতো। গ্রেফতারকৃত সালমান মুরব্বী আরসার ওলামা বডির প্রধান হওয়ার পর সে তার অধীনে আরসার টর্চার সেলের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করে। এছাড়াও সে টর্চার সেলের সদস্য হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করতো। সে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের বিভিন্ন লোকজন ও স্থানীয় বাঙ্গালীদের অপহরণ করে টর্চার সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে বড় অংকের মুক্তিপণ আদায়, পাশাপাশি আরসার ভিন্ন মতাদর্শীদের এই টর্চার সেলে নিয়ে এসে নির্যাতনের সাথেও সে জড়িত ছিল। ২০২১ সালে ডিজিএফআই “র কর্মকর্তা হত্যাকান্ডের সময়ে আরসার শীর্ষস্থানীয় নেতারা যে ক্যাম্পে অবস্থান করতো সে ঐ ক্যাম্পে খাদ্য সরবরাহে দায়িত্বরত ছিল ।

Comment here