ক্রাইমজাতীয়সারাদেশ

বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি ফাঁসিতে ঝুললো

দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকেও সাজা এড়াতে পারলেন না আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল মাজেদ, সাড়ে চার দশক আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রোববার প্রথম প্রহরে, অর্থাৎ ১২টা ১ মিনিটে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান জেলার মাহবুবুল ইসলাম।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে ছয় আসামি পলাতক ছিলেন, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মাজেদ তাদেরই একজন।

সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অন্য খুনিদের মত মাজেদও ‘পুরস্কার হিসেবে’ সরকারি চাকরিতে উঁচু পদ পেয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বিচারের পথ খুললেও দুই দশকের বেশি সময় ভারতে পালিয়ে থেকে বিচার এড়ান মাজেদ।

অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষে ২০০৯ সালের নভেম্বরে সর্বোচ্চ আদালত থেকে ১১ জনের ফাঁসির রায় আসে। তাদের মধ্যে পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি কার্যকর করা হলেও মাজেদসহ ছয়জন পলাতক থাকেন।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গত ৭ এপ্রিল ভোরে ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ৭২ বছর বয়সী মাজেদকে।

দীর্ঘদিন পলাতক থেকে আপিলের সুযোগ হারানো মাজেদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করলে তাও খারিজ হয়ে যায়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ভাষায়, বঙ্গবন্ধুর এই পলাতক খুনিকে গ্রেপ্তার করে শাস্তি নিশ্চিত করতে পারার বিষয়টি মুজিববর্ষে জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।

এ বছরই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে বাংলাদেশ, যার সমাপ্তি ঘটবে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে।

মাজেদকে ভোলায় দাফনে আপত্তি

গ্রেপ্তারের পর আদালতে আবদুল মাজেদ

গ্রেপ্তারের পর আদালতে আবদুল মাজেদ
হত্যাকাণ্ডে পুরস্কৃত

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন মাজেদ। তখন তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, “মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশগ্রহণ করেনি, সে জেলহত্যায় অংশগ্রহণ করেছেন বলে আমাদের জানা রয়েছে। খুনের পরে জিয়াউর রহমানের নির্দেশ মোতাবেক সে বঙ্গভবন ও অন্যান্য জায়গায় কাজ করেছে।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মাজেদ কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বে ছিলেন। অন্য খুনিদের সঙ্গে দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত বঙ্গভবনে ‘বিভিন্ন দায়িত্ব’ ছিল তার।

পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়ায় চলে যান মাজেদ। সেখানে তারা ছিলেন তিন মাস। এরপর ‘পুরস্কার হিসেবে’ তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাজেদকে পাঠানো হয় সেনেগাল দূতাবাসে।

জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ আবদুল মাজেদকে বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে উপসচিবের মর্যাদায় তিনি বিআইডব্লিউটিসিতে যোগ দেন।

পরে তাকে তখনকার যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ‘ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট’ শাখার পরিচালক করা হয়। এরপর দেওয়া হয় তখনকার জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের পরিচালকের দায়িত্ব।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বিচারের পথ খোলে। মামলার পর বিচারও শুরু হয়। সে সময় আটক হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে যান আবদুল মাজেদ, পালিয়ে চলে যান ভারতে।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানা যায়, ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে এতদিন ভারতেই পালিয়ে ছিলেন তিনি। তবে চার মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে তার স্ত্রী ঢাকা সেনানিবাসের এক নম্বর রোডের একটি বাসায় বসবাস করে আসছেন।

কে এই আবদুল মাজেদ?

এত আকাঙ্ক্ষার আসামি এত সহজে ধরা!

কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ, ফাইল ছবি

কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ, ফাইল ছবি
যেভাবে ফাঁসির মঞ্চে

মাজেদকে গত ৭ এপ্রিল ভোরে গ্রেপ্তার করার পর আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠান। এর পরপরই তার দণ্ড কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতাগুলো শুরু করে সরকার।

আদালত পরদিন তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে তা পড়ে শোনায়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সময় বহু বছর আগেই পেরিয়ে যাওয়ায় আবদুল মাজেদের সামনে সেই সুযোগ ছিল না।

ফাঁসির দড়ি এড়ানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে বুধবার সন্ধ্যায় তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। সেদিন রাতেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তা নাকচ করে দিলে মাজেদের দণ্ড কার্যকরের বিষয়টি কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

শুক্রবার বিকালে কেরানীগঞ্জ কারাগারে গিয়ে মাজেদের সঙ্গে শেষ দেখা করেন আসেন তার স্ত্রী সালেহা বেগম। ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়ার পর লাশ নেওয়ার জন্য শনিবার রাতে আবার তাদের কারাগারে ডাকা হয়।

এদিকে সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর শনিবার বিকাল থেকেই কারাগারের চারপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশ কারাগার ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করে।

কারা-কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যার পর থেকেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতাগুলো এগিয়ে নিতে থাকে। কারাগারের ফাঁসির মঞ্চও প্রস্তুত করা হয়, নিয়ম অনুযায়ী তওবা পড়ানো হয় ফাঁসির আসামিকে।

অতিরক্ত আইজি প্রিজন্স, ডিআইজি প্রিজন্স, সিনিয়র জেল সুপার, ঢাকার সিভিল সার্জন, কারাগারের দুজন সহকারী সার্জন, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি রাত ১১টার মধ্যে কারাগারে প্রবেশ করেন। মৃতদেহ রাখার জন্য আগেই কফিন এনে রাখা হয়।

সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয় বঙ্গন্ধুর খুনি মাজেদকে।

২০১৬ সালের ১০ এপ্রিল উদ্বোধন হওয়া এ কারাগারে এটাই ছিল কোনো আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রথম ঘটনা।

কারাগারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাজেদের দণ্ড কার্যকরে প্রধান জল্লাদ ছিলেন শাহজাহান, যিনি ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির ফাঁসি কার্যকর করেছিলেন।

পরে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা সাংবাদিকদের বলেন, “রাত ১২টা ১ মিনিটে আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তারা মৃতদেহ ভোলায় তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন, সেখানেই দাফন হবে।”

তবে মাজেদের চাচা শশুর আলী আক্কাস রাত পৌনে ৩টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ মৃতদেহ হস্তান্তর করলেও অ্যাম্বুলেন্স দেয়নি। তাদের অ্যাম্বুলেন্স পেতে সমস্যা হয়েছে।

“মাওয়া ফেরিঘাট বন্ধ থাকায় মাজেদকে এখন ভোলায় দাফন করা সম্ভব না। তাই আমরা মৃতদেহ সোনারগাঁও নিয়ে যাচ্ছি তার শ্বশুরবাড়িতে। সেখানেই দাফন করা হবে।”

মাজেদের শ্যালক শহীদুজ্জামান সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সোনারগাঁওয়ে মরদেহ নেওয়ার পর প্রশাসনের সহায়তায় জানাজা ও দাফন হয়।

“শান্তিপূর্ণভাবেই সব সম্পন্ন হয়েছে, কোনো সমস্যা হয়নি।”

মাজেদকে ভোলায় দাফনে আপত্তি

ফাঁসিতে ঝুলানোর আগে মাজেদকে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি

কারাগারে ফাঁসির আসামি মাজেদের সঙ্গে দেখা করে এলেন স্বজনরা

বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদের ফাঁসি যে কোনো দিন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

মাজেদের ফাঁসির মঞ্চ ‘প্রস্তুত’

উপরে বাঁ থেকে ঘড়ির কাটার দিকে: খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, মোসলেহউদ্দিন খান, আব্দুল মাজেদ ও এম রাশেদ চৌধুরী।
রইল বাকি ৫

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে জাতির জনককে যখন সপরিবারে হত্যা করা হল, বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান কেবল তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরে। ওই বছর ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হলে ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল এ মামলার রায়ে আবদুল মাজেদসহ ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাই কোর্টের রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। তাদের মধ্যে আসামি আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায়ে হাই কোর্টের সিদ্ধান্ত বহাল রাখলে পাঁচ আসামি রিভিউ আবেদন করেন।

তা খারিজ হয়ে যাওয়ার পর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি) মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে আবদুল মাজেদ ছাড়াও খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান সে সময় পলাতক ছিলেন।

শেষ পর্যন্ত মাজেদ ধরা পড়ে ফাঁসিকাষ্ঠে গেলেও বাকিদের শাস্তি নিশ্চিত করার কাজটি বাকি রয়ে গেল।

এই পাঁচ আসামির মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরীর কানাডায় আছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সরকারের সাড়া মেলেনি।

আরেক আসামি মোসলেম উদ্দিন পাকিস্তানে আছেন বলে তথ্য ছিল ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) কাছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলেও পাকিস্তান কোনো জবাব দেয়নি।

আর রশিদ ও ডালিম এখন কোথায় আছেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য এখনও জানতে পারেনি সরকার।

Comment here